হৃদয় ছুঁয়ে যায় এপিটাফের কথায়...

ইংরেজি শব্দ EPITAPH, যার বাংলা অর্থ স্মৃতিস্তম্ভের ওপরে উৎকীর্ণ লিপি। সাধারণত সমাধির ওপরে ওই সমাধিস্থ ব্যক্তির উদ্দেশে কোনো কথা লেখাকে এপিটাফ বা সমাধিলিপি বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির সমাধিতে বা স্মৃতিস্তম্ভের ওপর বেশ হৃদয়স্পর্শী এপিটাফ রয়েছে। তেমনি কুমিল্লার ময়নামতির ওয়ার সিমেট্রিতে শহীদ সৈনিকদের সমাধির ওপরও রয়েছে এপিটাফ। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের কোল ঘেঁষে রয়েছে এক উজ্জ্বল ইতিহাস ‘ওয়ার সিমেট্রি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া ৭৩৭ জন সৈনিকের সমাধিস্থল।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলমান বিভীষিকাময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার স্মৃতিচিহ্ন এই স্থান। এই স্থানটির অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে যেমন মুগ্ধ করবে, তেমনি এর ইতিহাস মনকে বিষাদময় করবে। এখানেই মাটির কোমলতায় পরম আদরে ঘুমিয়ে আছেন যুদ্ধ নামক অভিশাপে বলি হওয়া ৭৩৭ মানবপুত্র। তাঁরা কমনওয়েলথভুক্ত সেনা ও বিমানবাহিনীর জীবন উৎসর্গ করা সদস্য। প্রতিটি সমাধির শিয়রের প্রস্তরফলক বা এফিটাফ (ব্রঞ্জের পাতের ওপরে খোদাই করা) রয়েছে সেখানে সমাহিত সৈনিকের নাম, পদবি, রেজিমেন্ট, বয়স, মৃত্যুর তারিখ এবং ধর্মীয় প্রতীক। হাতে গোনা কয়েকটি সমাধি বাদে সব সমাধির এপিটাফে রয়েছে তাদের প্রিয়জনদের কিছু কথা। ওয়ার সিমেট্রি ঘুরে দেখার সময় চোখ আটকে গেল এমন কিছু সমাধিলিপিতে।
১৯৪৪ সালের ১১ জুন ৩০ বছর বয়সে নিহত হওয়া ব্রিটিশ লেফটেনেন্ট সি এইচ মাচেন ((Lieutenant C. H MACHIN)-এর সমাধিফলকে তাঁর স্ত্রীর দুটি লাইন HEARTS THAT LOVED YOU, WILL NEVER FORGET YOU.’ প্রিয় স্বামীর সমাধিফলকে স্ত্রীর লেখা এই লাইন দুটোর বাংলা অর্থটা যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যাবে, ‘যে হৃদয় তোমাকে ভালোবেসেছে, সেই হৃদয় কোনোদিনও তোমাকে ভুলবে না।’ ১৯৪৩ সালের ১৯ মে মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রাণ হারানো তরুণ বৈমানিক সার্জেন্ট জে ই আলিসন (SERGEANT J. E. ALLISON)-এর সমাধিফলকে নজর পড়ল TOO DEARLY LOVED TO BE FORGOTTEN’-এর বাংলা অর্থ অনেকটাই এমন- ‘অত্যধিক প্রিয় ভালোবাসা বিস্মৃত হয় না।’ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম সমাধিটার দিকে। কেন যেন অনায়াসেই আমার নেত্রাশ্রু পড়ল এপিটাফের ওপর। হৃদয়টা হাহাকার করল তার জন্য। কী অপরিমেয় ভালোবাসা। একে একে দেখলাম অনেকগুলো সমাধি। হৃদয়ে নাড়া দেওয়া কথা/উক্তি রয়েছে বাকিগুলোয়ও। কোনোটা বাবা বা মা তাঁর ছেলে জন্য, কোনোটা বোন তাঁর ভাইয়ের জন্য, কোনোটা ছেলে তাঁর বাবার জন্য, কোনোটা স্ত্রী তাঁর প্রিয় স্বামীর জন্য লিখেছেন। এসব এফিটাফ যুদ্ধপরবর্তী সময়ে প্রিয়জনের সমাধিতে লিখে গেছেন চিরনিদ্রায় শায়িত সেনাদের স্বজনরা।
A VOICE WE LOVED IS STILL, A PLACE IS VACANT IN OUR HOME WHICE NEVER CAN BE FILLED’ লাইন দুটো লেখা রয়েছে জে ই ডিইন (J E DEAN) নামের রয়েল ওয়েস্ট কেন্ট রেজিমেন্টের এক সেনার সমাধিফলকে। যিনি ১৯৪৪ সালের ১৩ জানুয়ারি মাত্র ২১ বছর বয়সে নিজের দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। K COLEMAN-এর পরিবারের সদস্যদের তাঁর প্রতি উৎসর্গকৃত এই লাইন দুটোর বাংলা অর্থ অনেকটা এমন, ‘একটি স্বর এখনো ভালোবাসি, আমাদের ঘরে একটি স্থান শূন্য হয়েছে, যেটি কখনোই পূরণ হবে না।’ ২৩ জুন ১৯৪৪ সালে প্রাণ উৎসর্গকারী রয়েল কানাডিয়ান এয়ারফোর্সের পাইলট অফিসার (J A FRASHER) ২৬ বছর বয়সে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া এই বীরের সমাধিফলকে তাঁর প্রিয়জনেরা লিখে গিয়েছে, FONDLY REMEMBERED BY WIFE AND DAUGHTER, PARENTS, BROTHERS AND SISTERS-এর বাংলা অনুবাদ ‘হার্দভাবে স্ত্রী ও মেয়ে, বাবা-মা, ভাই এবং বোনের স্মৃতিতে চিরস্মরণীয়।’
YEARS ROLL BY BUT MEMORIES STAY AS NEAR AND DEAR AS YESTERDAY’ উক্তিটি রয়েছে ২৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ সেনা সদস্য এল সি টাটোন (L C TATTON)-এর সমাধিফলকে, এর বাংলা অর্থ হয়, ‘সময় চলে যায় কিন্তু প্রিয়জনের অতীতের স্মৃতি সদা বিরাজ করে।’ যিনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ সালে নিহত হয়েছেন।
SWEET JESUS HAVE MERCY ON THE SOUL OF KEVIN WHO GAVE HIS TODAY FOR OUR TOMORROW. ‘যিশু কেভিনের আত্মার ওপর ক্ষমাশীল হবেন, যে তার আজ আমাদের আগামীর জন্য বিসর্জন দিয়েছে’ বলে পরিবারের সদস্যরা ১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৩০ বছর বয়সে প্রাণ হারানো কে কোলিম্যান (K COLEMAN)-এর জন্য প্রার্থনা করেছেন।
৩১ মে ১৯৪৫ সালে ২৭ বছর বয়সে নিজের দেশকে ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ করা জে কে রিচার্ডস (J K RICHARDS)-এর সমাধিলিপিতে লেখা এই উক্তিটি যে কারো হৃদয়কে বিষাদগ্রস্ত করে তুলবে, ‘HE DIED FOR THOSE HE LOVED TO LIVE IN PEACE’, বাংলায় এর মানে হয়, ‘সে জীবন দিয়েছে যাতে তার প্রিয় মানুষগুলো শান্তিতে বসবাস করতে পারে।’
AT THE GOING DOWN ON THE SUN AND IN THE MORNING. WE WILL REMEMBER.’ পড়ন্ত বিকেলে এবং সকালে আমরা তাঁদেরকে মনে করব’ এই হৃদয় ছোঁয়া শব্দগুলো লিপিবদ্ধ রয়েছে সেনাবাহিনীর বীর টি ডব্লিউ জি রোয়ানাইট (T W G ROANIGHT)-এর সমাধিফলকে। যিনি ৫ মে ১৯৪৫ সালে নিহত হয়েছেন।
৩১ জুলাই ১৯৪৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে রয়েল এয়ারফোর্সের কনপোরাল কে নিউই (K NEWEY)-এর সমাধিফলকে পিতলের হরফে লেখা রয়েছে MAY YOUR REWARD IN HEAVEN BE AS GREAT AS YOUR SACRIFICE ON EARTH এই শব্দগুলো। যার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এমন, ‘স্বর্গে তুমি বিশাল পুরস্কার পাবে, যা তোমার পৃথিবীতে করা এই বলিদানের মতো বিশাল হবে।’
২৪ জুন, ১৯৪৪ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে নিহত হওয়া রয়েল এয়ারফোর্সের বিমান সেনার সমাধিফলকে তাঁর স্ত্রী, বাবা-মা তাঁর উদ্দেশে এই বাক্যটি লিখে গেছেন, BELOVED HUSBAND OF PAT & SON OF GODFREY AND DOREEN WILLIAMS, LIFE IS ETERNAL. যার অর্থ, ‘প্যটের প্রিয় স্বামী এবং গডসে ও ডোরেন উইলিয়ামের পুত্র, জীবন শাশ্বত’ ১৯৪৩ সালের ২ এপ্রিল রয়েল আর্টিলারির টি টি নক্স (T T KNOX) নামের সেনাসদস্যের সমাধির প্রস্তরফলকে, ‘HE DIED THAT WE MIGHT LIVE.’ বাংলায় ‘সে তার জীবন উৎসর্গ করেছে যেন আমরা বেঁচে থাকতে পারি’। তাঁর পরিবারের সদস্যদের লিখে যাওয়া এই বাক্যটি এখানে শুয়ে থাকা প্রত্যেক সেনার অসামান্য আত্মত্যাগের অতিসামান্য এক স্বীকৃতি।
এমন হৃদয়ছোঁয়া বাক্য লেখা আছে প্রায় সব সমাধিফলকেই। যেগুলো এখানে শায়িত বীর সেনানীদের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা হিসেবে লিখে গিয়েছেন।
এ সমাধিস্থলে ব্রিটেনের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন, ভারতীয় উপমহাদেশের ১৭৮ জন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন, নিউজিল্যান্ডের চারজন, দক্ষিণ আফ্রিকার একজন, রোডেশিয়ার তিনজন, পোল্যান্ডের একজন, বেলজিয়ামের একজনসহ রয়েছেন ২৪ জাপানির (যুদ্ধবন্দি) সমাধি। ঘুরে ঘুরে অনেক সমাধি দেখে এরপর প্রশস্ত পথ ধরে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই দেখলাম সিঁড়িবিশিষ্ট একটি বেদি। তার ওপর শোভা পাচ্ছে খ্রিস্টধর্মীয় প্রতীক ‘ক্রুশ’। বেদিটির দুই পাশে রয়েছে দুটি তোরণ ঘর। এই তোরণ ঘরের মধ্যে পথ এগিয়ে চলছে পেছনের দিকে। সমাধিস্থলটির পেছনের অংশেও অংশেও রয়েছে অনেক সমাধি। সমাধির সারি সারি মিছিলের এক অংশ যেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংগঠন ‘কমনওয়েলথ গ্রেইভস কমিশনের’ তত্ত্বাবধানে সমাধিস্থলটি পরিচালিত হয়। পেছনের অংশে রয়েছে মুসলমান এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী সৈন্যদের সমাধি। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে রয়েছে জাপানের (শক্রপক্ষ) ২৪ জন সৈনিক ও বেসামরিকদের সমাধি। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফটকের দেয়ালে বাংলায় এবং ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ ইতিহাস সম্বলিত পিতলের ফলক। তার প্রশস্ত হাঁটার পথ যার দুই ধারেই সবুজ ঘাসের মধ্যে সৈনিকদের সারি সারি সমাধি। প্রতিটি সমাধিকে ঘিরে রেখেছে নানা জাতের নানা রঙের ফুলের গাছ। এ গাছগুলোয় ফুল ফোটে সমাধির প্রতিটির নিহত সৈনিকের জন্য। ফুলের ছায়ায় চিরকালের নিদ্রা আর ভাঙবে না তাঁদের।