তফসিলের আগেই বিএনপির ৮ দাবি, ক্ষমতায় গেলে ১২ লক্ষ্য

সরকারের কাছে আট দফা দাবি তুলে ধরেছে বিএনপি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তাদের দাবিগুলো পূরণ করতে বলেছে সরকারকে।
আজ রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত জনসভায় দাবিগুলো তুলে ধরেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে ক্ষমতায় গেলে নিজেদের ১২টি লক্ষ্যের কথাও জানান বিএনপির এই শীর্ষস্থানীয় নেতা।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। সেই লক্ষ্যে আগামী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নিম্নবর্ণিত দাবিগুলো পূরণ করতে হবে :
১. দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার
২. জাতীয় সংসদ বাতিল করা
৩. সরকারের পদত্যাগ ও সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা
৪. যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পূর্ণ গঠন করতে হবে
৫. সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্রবাহিনী নিয়োগ নিশ্চিত করা
৬. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার বিধান নিশ্চিত করা
৭. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন-প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাদের ওপর কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ না করা
৮. ক. দেশের সব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার
খ. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনী ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো ধরনের মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা
গ. পুরোনো মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার না করার নিশ্চয়তা
ঘ. কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা।
ক্ষমতায় গেলে বিএনপির ১২ লক্ষ্য
ক্ষমতায় গেলে নিজেদের ১২টি লক্ষ্যের কথাও তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। লক্ষ্যগুলোতে জনগণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি পর্যন্ত আওতাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের তুলে ধরা লক্ষ্যগুলো হলো-
১. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা।
২. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলীয়করণের ধারার বদলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
৩. রাষ্ট্র ক্ষমতায় গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
৪. স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
৫. স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে আরো আধুনিক, শক্তিশালী ও কার্যকর করা।
৬. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৭. কঠোর হস্তে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও অধিকতর কার্যকর করা।
৮. সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা।
৯. ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই মূলনীতিকে অনুসরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণ করে স্বাধীনতা পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক এবং সৎ-প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১০. কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় না দেওয়া এবং কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়া।
১১. ক) নিম্ন আয়ের নাগরিকদের মানবিক জীবনমান নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বেতন-মজুরি নির্ধারণ ও আয়ের বৈষম্যের অবসান করতে সমতাভিত্তিক নীতি গ্রহণ করা এবং সকলের জন্য কর্মসংস্থান, শিক্ষিত বেকারদের জন্য বেকার-ভাতা, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবীমা চালু, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক করা।
খ) স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক এবং উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে জীবনমুখী শিক্ষানীতি চালু করা, প্রযুক্তি বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে মানবসম্পদের উৎকর্ষ সাধন করা, জাতীয় উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গ. তৈরি পোশাক শিল্পের অব্যাহত উন্নয়ন, শিল্প ও রপ্তানিখাতকে বহুমুখী করা, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে উন্নয়নের ধারাকে গ্রামমুখী করা, বৈদেশিক কর্মসংস্থান সম্প্রসারণ, ঝুঁকিমুক্ত ও প্রবাসী জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতিভার বিকাশ ও তাদের আধুনিক চিন্তা চেতনাকে জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা, তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তিখাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
১২. সব প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসানে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করা।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসা, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ভোটের সময় সেনা মোতায়েনসহ বিভিন্ন দাবিতে আজকের জনসভা হয়। দুপুর ২টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে জনসভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। চলে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। জনসভায় প্রধান অতিথি করা হয় কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে।
গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ বিএনপিকে আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার জন্য ২২ শর্তে অনুমতি দেয়। এরপরই চলে সভা সফল করতে বিএনপির প্রস্তুতি।
এর আগে আজকের এই জনসভার তারিখ বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করে বিএনপি। প্রথমে ২৭, পরে ২৯, এরপর আজ ৩০ সেপ্টেম্বর জনসভা করে দলটি।
জনসভার ঘোষণা দেওয়ার পর দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকার আশপাশের নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মূলত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকায় বড় সভা করে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করা ও নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বিএনপির আজকের এই জনসভা। সেই জন্য ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলো থেকে দলের নেতাকর্মীদের সভায় অংশ নিতে নির্দেশ দেয় হাইকমান্ড।
আজকের এই জনসভা দুপুর ২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল ৯টা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা সভাস্থলে এসে উপস্থিত হন। বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসভাস্থলে আসতে থাকেন ঢাকার বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাঁরা মৎস্য ভবন, রমনা পার্ক ও শাহবাগ থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে প্রবেশ করেন। এ সময় গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। বিএনপি নেতাকর্মীদের মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে আসার ফলে মৎস্য ভবন, শাহবাগ, কদম ফোয়ারা এলাকা হয়ে ওঠে মিছিলের নগরী। এসব মিছিলের মিলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যেখানে আজ দীর্ঘদিন পর জনসভা করে বিএনপি।
এসব ছোট ছোট মিছিল নিয়ে আসা নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে নানা স্লোগান দেন। তাদের কণ্ঠে ছিল, ‘জেলের তালা ভাঙব, খালেদা জিয়াকে আনব’, ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দি থাকতে দিব না’; ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’ এবং ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি, আন্দোলনের শক্তি’।
এদিকে জনসভা ঘিরে সব ধরনের নাশকতা ও হট্টগোল ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে ছিল পোশাকধারী পুলিশ ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। এ ছাড়া ছিল বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় পুলিশের সাঁজোয়া যান।