সাতক্ষীরায় বোমাবাজি, কেন্দ্র দখল-গুলি

রাতে কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট দেওয়া এবং দিনভর ভোট কাটাকাটি ও তাণ্ডব সৃষ্টিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরায় শেষ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা তাঁদের বাহিনী নিয়ে এই ভোট ডাকাতিতে মেতে উঠেছিলেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
নির্বাচনে জাল ভোট দেওয়া ছাড়াও বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এমনই এক ঘটনায় তালা উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নে পুলিশের গুলিতে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী আহত হন।
অপরদিকে নির্বাচনে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলার বিষয় স্বীকার করে নিয়ে প্রশাসন ১৪টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দেয়। এ ছাড়া ভোট জালিয়াতি, তাণ্ডব সৃষ্টি, এজেন্টদের বের করে দেওয়া এবং মারপিটসহ নানা ঘটনার প্রতিবাদে অন্তত চারজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন।
এর আগে সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ করা গেলেও ভোটারদের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছিল। দিনভর কেন্দ্রগুলোতে পুরুষ ভোটারের উপস্থিতি খুব কমই লক্ষ করা গেছে। প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, বেলা ১১টার মধ্যে চেয়ারম্যান পদের ভোটগ্রহণ জালিয়াতির মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়। এর পর থেকে কোনো কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদের কোনো ব্যালট ছিল না। প্রার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, তাঁদের সমর্থকরা কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে এসেছেন। তাঁদের বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যানের ভোট হয়ে গেছে, আপনারা মহিলা সদস্য ও সাধারণ সদস্য পদে ভোট দিয়ে যান।’ তাঁরা আরো বলেন, তাঁদের হাতে সদস্য পদের দুটি করে ব্যালট তুলে দেওয়া হয়।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সোমবার মধ্যরাত থেকে আশাশুনির শ্রীউলার নাকতাড়া কালীবাড়ি কেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবু হেনা শাকিল ও তাঁর সমর্থকরা। এ সময় জাল ভোট দেওয়ার মচ্ছব বসে। তালার খলিলনগর ইউনিয়নের হরিশচন্দ্রকাটী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রণব ঘোষ বাবলু তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্যালট হাতিয়ে নেন। এ দুটি কেন্দ্রে চেয়ারম্যানের ব্যালটে সিল মারেন তাঁরা। তালার কুমিরা ইউনিয়নের দাদপুর, অভয়তলা ও ভাগবহা কেন্দ্র দখল করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজিজুল ইসলাম জাল ভোটের উৎসবে মেতে ওঠেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ওই বাহিনীর বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ভাগবহা কেন্দ্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আওয়ামী লীগ কর্মী রুহুল কুদ্দুস ও রুবেল শেখ। তাঁদের সাতক্ষীরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান জানিয়েছেন, জালভোট প্রদান, ব্যালট ছিনতাই এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে তালার ভাগবহা, দাদপুর ও অভয়তলা কেন্দ্র, সাতক্ষীরা সদরের মাহমুদপুর হাইস্কুল, গাংনিয়া, ভাড়ুখালী ও আলীপুর, শ্যামনগরের জয়াখালী মহাজাবিন স্কুল, পূর্ব কৈখালী স্কুল এবং শৈলখালী মাদ্রাসা, কলারোয়ার কুশোডাঙ্গার কলাটুপি, শাকদাহ ও কেরালকাতার বলিয়ানপুর এবং দেবহাটার পারুলিয়া ইউনিয়নের খেজুরবাড়িয়া কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে শ্যামনগরের কৈখালীর আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিমের হাতে প্রহৃত হয়েছেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী। এ উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা ছাড়া বাকি আটটি কেন্দ্র পুরোপুরি দখল করে নেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম আযম টিটো।
সদর উপজেলার রামেরডাঙা কেন্দ্রে তিনটি, কলারোয়ার দেয়াড়ায় ১০টি এবং আশাশুনির পূর্ব একসরায় সন্ত্রাসীরা পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, কালীগঞ্জের ধলবাড়িয়া এবং মৌতলা ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে বেলা ১১টার পর থেকে শুধু সদস্য পদে দুটি করে ব্যালট ভোটারদের হাতে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানের ব্যালট আগেই শেষ হয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
আশাশুনির বুধহাটার কলেজিয়েট কেন্দ্র এবং প্রতাপনগরের সাতটি কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা।
কালীগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের আনারস প্রতীকধারী স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, নীলকণ্ঠপুর মাদ্রাসা, বন্দকাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়, এলেমপুর ও বেজুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র আওয়ামী লীগদলীয় লোকজন জোর করে দখল করে নেন।
সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বিএনপি দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুর রউফ অভিযোগ করে বলেন, তাঁর ইউনিয়নের বেশির ভাগ কেন্দ্রে জালভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। সাধারণ ভোটাররা চেয়ারম্যান পদে ভোট দিতে না পেরে ফিরে গেছেন।
সদর উপজেলার ধূলিহরের কয়েকটি কেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির প্রার্থী মোদাচ্ছেরুল হক হুদা।
কলারোয়ার যুগিখালী ইউনিয়নে বিএনপি দলীয় প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ওজিয়ার রহমান আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থী রবিউল হাসানের সহকর্মী জনযুদ্ধ ক্যাডারদের তাণ্ডবের মুখে নিজেদের ইউনিয়ন ছেড়ে পাশের ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্র ঘুরে ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি।
যুগীখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রভাষক মিজান আক্তার বলেন, তাঁর কেন্দ্রে ভোটাররা সকাল সকাল ভোট দিয়ে চলে গেছেন।
বাটরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জালভোট দেওয়ার সময় আবু রায়হান ও আল আমিন নামের দুই যুবককে আটক করে পুলিশ। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবুল কাসিম মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। এই কেন্দ্রে ভোট শেষ হয়ে যায় বেলা ১১টার মধ্যে।
কালীগঞ্জের তারালি ইউনিয়নের বিএনপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শরীফ আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, সেখানকার কেন্দ্রগুলোতে জাল ভোট চলছিল। তিনি ও তাঁর এজেন্টরা প্রতিবাদ করতে গেলে অন্তত ১২ জন মারধরের শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হলেন রাজু, সেলিম, এবাদুল, হাফিজুল, করিম, বাবু, শাহিন, আমির ও সাইফুল।
শরীফ আব্দুর রাজ্জাক জানান, জালভোট দেওয়ায় দুপুর ১২টার মধ্যে চেয়ারম্যানের ব্যালট শেষ যাওয়ায় ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। তিনিও সংবাদ সম্মেলন করে এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এদিকে তালার হরিশচন্দ্রকাটী কেন্দ্রে ভোট ডাকাতির সময় বাধা দিতে গিয়ে আনসার সদস্য মিরাজ, কামরুল, ফরিদা ও নার্গিস আহত হয়েছেন। তালার জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তাঁর ইউনিয়নের কলিয়া ও লক্ষ্মণপুর কেন্দ্রে লাঙল প্রতীক সম্বলিত কোনো ব্যালট না আসায় তিনি ভোট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এ দুটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে পুনরায় ভোট নেওয়া হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
তালার জাতপুর কেন্দ্রে জালভোট দেওয়ার সময় যুবলীগকর্মী ফিরোজ বিশ্বাসকে আটক করেও পুলিশ অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দিয়েছে।
জেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, কেন্দ্রগুলোতে পুরুষ ভোটারের উপস্থিতি কম থাকলেও নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশি ছিল। এ ছাড়া ভোটার হওয়ার বয়স হয়নি এমন বয়সের বিপুলসংখ্যক কিশোরকে ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ও তার আশপাশে দলবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
প্রার্থী ও সাধারণ ভোটাররা অভিযোগ করেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছে ছিল সিল। রাতে ও দিনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে বেরিয়ে যায় তারা। কলারোয়ার দেয়াড়া ইউনিয়নের দেয়াড়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে তারা বেশ কয়েকটি বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।