নিরাপদে নামতে সাহায্য করব, প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়া

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা এখন ‘বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো’ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে নামতে ভয় পাচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমরা আপনাকে নিরাপদে নামতে সাহায্য করব। আমরা আপনার মতো জিঘাংসাপরায়ণ নই।’
আজ রোববার রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন খালেদা জিয়া। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের শেষে তিনি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি বিনা ভোটে ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করুন। এতে তো আপনার ক্ষমতা যাচ্ছে না। আপনি অনেক অপকর্ম করেছেন। এখন রাষ্ট্রক্ষমতা আপনার কাছে বাঘের পিঠে সওয়ার মতো হয়েছে। এখন আপনি নামতে ভয় পাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাকে নিরাপদে নামতে সাহায্য করব। আমরা আপনার মতো জিঘাংসাপরায়ণ নই। ধ্বংসের মনোবৃত্তি বদলান। আমি আর আপনি একই সমতলে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করব। এরপর মানুষ যাকে বেছে নেবে, সে-ই ক্ষমতায় বসব।’
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণ, প্রার্থী নির্বাচন, প্রচারণায় বাধাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেন বিএনপির চেয়ারপারসন। সে সঙ্গে তিনি সিটি করপোরেশনের ভোটারদের উদ্দেশে বিএনপি সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দেওয়ারও আহ্বান জানান।
শুরুতেই খালেদা জিয়া বলেন, ‘প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে প্রতিবেশী নেপাল ও ভারতে বহু মানুষের প্রাণহানি এবং আমাদের দেশের আহত ও নিহতের ঘটনায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত। বেদনার্ত মন নিয়ে অনেক দিন পর সরাসরি আপনাদের মুখোমুখি হয়েছি।
আমি কেমন ছিলাম এবং এখনো কেমন আছি, আপনারা ভালো জানেন। দীর্ঘদিন আপনারা আমার সঙ্গে কষ্ট করেছেন। এখনো করছেন। এর জন্য আমি আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
‘সাংবাদিকতা হচ্ছে সত্য অনুসন্ধান এবং তা মানুষের সামনে তুলে ধরার এক কষ্টকর মহান পেশা। এই পেশায় যারা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়োজিত, আমরা তাদের বরাবর সম্মান করি। আমি আশা করি, দেশ-জাতির বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে সত্যের প্রতি এই অবিচল নিষ্ঠা আপনারা সাহসের সঙ্গে অব্যাহত রাখবেন। কারণ, দেশের মানুষ আপনাদের ওপর অনেক বেশি ভরসা করে,’ বলেন বিএনপির প্রধান।
‘প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের উসকানিতে আমার ওপর হামলা’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, গত কিছুদিন তাঁর গাড়িবহরে হামলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের উসকানির ফলে।
আজ সংবাদ সম্মেলনে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার হাতে কোনো বাহিনী নেই। আমার আছে আল্লাহর রহমত ও দেশবাসীর সমর্থন ও দোয়া। এর ওপর নির্ভর করেই আমি রাজপথে নেমেছি। আমি জনসংযোগে নামতেই যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে, তাতে তাদের এতদিনকার সব প্রচার মিথ্যা হয়ে গেছে। তাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন; সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়েছেন।’
খালেদা জিয়া বলেন, সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উত্তরা, কারওয়ান বাজারে আমার ওপর হামলা হয়েছে। হামলায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। হামলাকারীদের পুলিশ পুরোপুরি সহায়তা করে। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আমি তখন সবেমাত্র গাড়িতে উঠে বসেছি। আমি যে পাশে বসা ছিলাম, তার কাচ ফেটে যায়। আল্লাহর রহমতে আমার জীবন বেঁচে যায়। কতটা মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করলে বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ ফেটে যায়?’
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদন, হামলাকারীদের নামধাম, সাংগঠনিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এদের কয়েকজনকে ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থীদের প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যায়। কাজেই এসব পরিকল্পিত হামলা, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বারবার হামলা চালানো হলেও একজন সন্ত্রাসীকে ধরা হয়নি; বরং যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আমাদের সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের।’
‘আমার প্রাণনাশের লক্ষ্যে হামলাকে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নাটক আখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমি মর্মাহত। আমি বুঝতে পারি এর কোনো বিচার হবে না। এরা একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে আমি ভয় পাই না। জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ। তিনি রক্ষা করলে অন্য কেউ আমাকে হত্যা করতে পারবে না। এই হত্যাচেষ্টার ন্যায়বিচার আল্লাহ একদিন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি,’ বলেন খালেদা জিয়া।
‘সন্ধান চাই’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান খোকনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর এক মাসের বেশি সময় হয়ে গেছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিষ্ঠুর বিদ্রূপ করেছেন। তাঁদের ব্যাপারে আমরা উৎকণ্ঠিত। আমরা তাঁদের সন্ধান চাই।’
খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘দেশে এখন কোনো মানুষের সামান্যতম নিরাপত্তাও নেই। দেশে তো একটা সরকার আছে। কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা ও নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় তাদের কোনো দৃষ্টি নেই। কেননা, তারা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। তাদের ভাবনা কেবল কীভাবে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা যায়। এ লক্ষ্যে তারা কেবল বিরোধী মতকে দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করে রেখেছে। ফলে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। ঢাকার কাছে আশুলিয়ায় দুর্ধর্ষ ব্যাংক ডাকাতির সময় আটজন নিহত হয়েছেন। কারো কোনো বিচার পাওয়ার অধিকার নেই।’
সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির প্রধান বলেন, ‘বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সম্মানের সেই কালচার শেখেনি। কাউকে তারা সম্মান করতে জানে না। ফলে তাদেরকেও কেউ সম্মান করে না। নিম্ন রুচির এই মানুষেরা অপকৌশলকে কৌশল ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। জনগণের সমর্থন নয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই তারা জেতার পথ বলে ধরে নিয়েছে। সংলাপ ও যুক্তির পথ তারা এড়িয়ে চলতে চায়।’
‘দেশকে আবারো গণতান্ত্রিক করতে হবে’
খালেদা জিয়া লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি গণতান্ত্রিক স্বদেশ। সে জন্য এ দেশের মানুষ বারবার রক্ত দিয়েছে। সেই গণতন্ত্রকে আজ আবারো হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। এই রাষ্ট্রকে আবার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। আসুন, সবাই দিলে দেশ ও জনগণকে বাঁচাই।’
‘আলোচনার জন্য এক বছর অপেক্ষা করেছি’
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘ক্ষমতাসীন ছাড়া দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এবং বেশির ভাগ মানুষের দাবি হচ্ছে, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন। আলোচনার মাধ্যমে সেই সমঝোতা প্রতিষ্ঠা হয়নি বলেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটসহ অধিকাংশ দল সেই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে নির্বাচনের নামে যে-প্রহসন হয়েছে, তা কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘কথা ছিল, এর পর আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতার ভিত্তিতে সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচন হবে। সেই আলোচনার জন্য আমরা এক বছর অপেক্ষা করেছি। এর পর প্রহসনের নির্বাচনের বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা ঢাকায় সমাবেশের কর্মসূচি দিলে ক্ষমতাসীনরা কী ধরনের সন্ত্রাসী পথ বেছে নেয়, তা সকলেরই জানা। এর প্রতিবাদে এবং সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করলে তারা আরো বেশি সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। বেছে নেয় নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের পথ। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচি মোকাবিলায় ক্ষমতাসীনরা ঘৃণ্য অপকৌশল অবলম্বন করেছে। আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। আমাদের দল-জোটের সিনিয়র নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কোনো নেতা বিএনপির পক্ষ থেকে কথা বললেই তাকে আটক অথবা গুম করে ফেলে।’
‘প্রহরায় চলা যানবাহনে কীভাবে হামলা হয়েছে, তা এখনো রহস্যের’
অবরোধের সময় সশস্ত্র প্রহরায় চলাচলরত যানবাহনে কীভাবে হামলা হয়েছে, তা এখনো রহস্যময় বলে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘আমাদের সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয়নি। রাজপথে নামার চেষ্টা করলেই গুলি চালিয়েছে কিংবা ধরে নিয়ে গিয়ে দৈহিক নির্যাতন করেছে। দলীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের কর্মসূচি ভঙ্গ করতে পুলিশ-র্যাব-বিজিপির পাহারায় রাজপথে ও মহাসড়কে জোর করে যানবাহন নামিয়েছে। সেসব যানবাহনে রহস্যজনক বোমা হামলায় অনেক নিরপরাধ মানুষ নিহত ও দগ্ধ হয়েছে। সশস্ত্র প্রহরায় চলাচলরত যানবাহনে কীভাবে এমন হামলা হয়েছে এবং ঘটনাস্থল থেকে কেন অপরাধীরা ধরা পড়েনি, তা আজো রহস্যে ঢাকা।’
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায় মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তাদের বাড়িঘর থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেককে বিনা বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নৃশংস নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করা হয়েছে অনেক তরুণকে। বিরোধী দলের কর্মীদের ধরে পুলিশ দিয়ে মিথ্যা মামলা সাজানোর সুযোগ করে দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আর্থিক পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে। অথচ অস্ত্র, গুলি, বোমাসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেকে ঘটনাস্থল থেকে ধরা পড়ার পর ওপরের নির্দেশে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে চালানো হয়েছে একতরফা অসত্য প্রচারণা।’
‘টাকা নেবেন কিন্তু বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবেন’
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেউ ভোটের বিনিময়ে টাকা দিতে চাইলে সেই টাকা নিলেও নিজের বিবেক অনুযায়ী ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘কত অপকর্ম যে এরা করে চলেছে তার ইয়াত্তা নেই। এত সব অপরাধের বিরুদ্ধে আমি ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীকে আগামী ২৮ এপ্রিল মঙ্গলবার নীরব প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদের ভোট অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক বিরাট শক্তি। ভোট হচ্ছে জনগণের এক বিরাট ক্ষমতা। সঠিকভাবে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করুন। নীরব বিপ্লব ঘটান। আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। মা-বোন, মুরুব্বি, তরুণসহ সব বয়স ও শ্রেণী-পেশার ভোটার সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে যাবেন। লাইন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেবেন। অনিয়ম ও কারচুপি দেখলে সবাই মিলে প্রতিবাদ করবেন। মনে রাখবেন, দেশের সম্পদ লুটপাট করে এবং আপনাদের রক্ত শুষে এরা টাকার পাহাড় গড়েছে। কাজেই এরা যে টাকা বিলাচ্ছে, সেটা আপনাদেরই টাকা। ওদের কাছ থেকে এ টাকা নিলেও ভোট বিক্রি করবেন না। টাকা নেবেন কিন্তু বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবেন। কারণ, ভোট বিক্রি আর ঈমান বিক্রি একই কথা। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরেরা যেভাবে উগ্র-সন্ত্রাসী ও দাম্ভিক হয়ে উঠেছে কোনোভাবে এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফল কেড়ে নিতে পারলে তারা আপনাদেরকে আর মানুষ বলেই গণ্য করবে না।’
বিএনপির চেয়ারপারসন আরো বলেন, ‘এবার নিজেদের স্বার্থেই বুঝে-শুনে ভোট দিতে হবে এবং ভোটের ফল বুঝে নিতে হবে। আমি নগরবাসীর প্রতি আবেদন করছি, আপনরা দয়া করে ঢাকা দক্ষিণে আমাদের সমর্থিত প্রার্থী মীর্জা আব্বাসকে মগ মার্কায়, ঢাকা উত্তরে তাবিথ আউয়ালকে বাস মার্কায় এবং চট্টগ্রামে মনজুর আলমকে কমলালেবু মার্কায় ভোট দিন। কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর পদেও আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিন। আপনার ভোট হোক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভোট। আপনারা ভোট হোক বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন, উন্নত, আধুনিক, যানজটমুক্ত, পরিকল্পিত ও নিরাপদ নগরী গড়ার পক্ষের ভোট। আমরা নবীন ও প্রবীণ এবং অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সমন্বয় করে প্রার্থী বাছাই করেছি। আমরা মিথ্যা ও অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পক্ষে নই। শুধু বলব, আপনি দয়া করে পরিবর্তনের পক্ষে, স্বস্তির পক্ষে, শান্তির পক্ষে আপনার ভোটটি দিন।’
ভোট শেষে বিকেল থেকে ভোটকেন্দ্রে পাহারা বসাবার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে আপনারা কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। যাতে আপনাদের দেওয়া রায় ওরা বদলে ফেলতে না পারে। ভোটের দিন এবং এর পর কেন উসকানির ফাঁদে পা না দেওয়ার এবং কোনো গুজবে কান না দেওয়ার জন্য আমি অনুরোধ করছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার ফলাফল মেনে নেওয়ার জন্যও আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
‘নষ্ট রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ’
বিএনপি লাশের রাজনীতি করে না জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বোমা হামলায় নিহত ও আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছি। এ ধরনের হত্যার তীব্র নিন্দা করেছি। বোমা হামলায় এবং বিনা বিচারে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষকে হত্যার ঘটনার ব্যাপারে আমরা আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছি। আমি আজ আবার তাঁর পুনরুল্লেখ করে বলছি, হত্যা, নাশকতা, সন্ত্রাস ও লাশের রাজনীতি আমরা করি না। সন্ত্রাসনির্ভর নষ্ট রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ। অতীত ও নিকট ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করে।’ তিনি বলেন, ‘এবারেও তারা জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ভীত হয়ে দুধারা ছুরির মতো অপকৌশল নিয়েছিল। আমাদের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে সশস্ত্র প্রহরায় একদিকে পথে যানবাহন নামিয়েছে।’
‘অপরদিকে সেই যানবাহনে বোমা হামলায় মানুষ হত্যা করে তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপিয়ে হত্যা, নির্যাতন, গুম, গণগ্রেফতার ও একতরফা অপপ্রচারের পথ উন্মুক্ত করেছে। সৌভাগ্যের বিষয়, এই অপরাজনীতি এবং একতরফা অপপ্রচার দেশের বেশির ভাগ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। কারণ, তারা জানে এবং দেখে আসছে যে, সন্ত্রাসনির্ভর নষ্ট রাজনীতি ও অপপ্রচারে আওয়ামী লীগ কতটা পারদর্শী,’ যোগ করেন খালেদা জিয়া।
‘শেখ হাসিনা মেরেও জিতেছেন, কেঁদেও জিতেছেন’
আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা, বর্তমানে কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর একটি উক্তি তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, “কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সাম্প্রতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন : ‘শেখ হাসিনা মেরেও জিতেছেন, কেঁদেও জিতেছেন।’ মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিক জনাব সিদ্দিকীর সঙ্গে আমি একটু দ্বিমত পোষণ করতে চাই। মানুষ মারায় যদি জেতার প্রশ্ন আসে, শেখ হাসিনা তাতে অবশ্যই জিতেছেন। তবে কেঁদে তিনি জিততে পারেননি। শেখ হাসিনার পরিকল্পিত নৃশংসতার শিকার হয়ে যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জন্য তাঁর কান্নাকে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ‘কান্নার অভিনয়’ হিসেবেই মনে করেন। তাই তিনি যত কাঁদেন এবং যত অপপ্রচার করেন, মানুষ তত বেশি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাঁর দিক থেকে। আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি। মানুষের মনের অব্যক্ত ভাষা পাঠ করতে পারি। দেশের মানুষ কী চায়, তা আমরা জানি ও বুঝি। মানুষ যে সীমাহীন অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়নি, তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি, আপনারাও দেখছেন।’
যেসব কারণে সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ
খালেদা জিয়া বলেন, ‘নির্বাচনটি নির্দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তিনটি সিটিতে তাঁর মনোনীত মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁদের সর্বব্যাপী আক্রমণে পর্যুদস্ত বিএনপি সিটি নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু আমরা সিনিয়র সিটিজেন ও পেশাজীবীদের মনোনীত প্রার্থীদের তিনটি সিটি করপোরেশনে সমর্থন দিয়ে এই নির্বাচনে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই সরকারের অধীনে, যারা ভোটারবিহীন নির্বাচনী প্রহসনে রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করেছে। এই নির্বাচন হচ্ছে চরম পক্ষপাতদুষ্ট ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে রয়েছে চরমভাবে দলীয়করণ করা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কাজেই এ নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, সে সন্দেহ দেশবাসীর মতো আমাদেরও ছিল এবং আছে।’
খালেদা জিয়া যোগ করেন, ‘তা সত্ত্বেও আমরা কয়েকটি কারণে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
১. আমরা শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি করেছি। স্থানীয় নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের ওই দাবি নেই।
২. দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোট অংশ নিয়েছে। সব সিটিতে আমরা বিপুল ভোটে জিতেছি। উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনগুলোতে প্রথম পর্বেও আমাদের সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুলভাবে জয়লাভ করে। এ পরিস্থিতি দেখে আওয়ামী লীগ কেন্দ্র দখল, সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি ও কারচুপি করে অনেক জায়গায় আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়। তবে জনগণের বিপুল সমর্থন যে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের প্রতি রয়েছে, তা সব নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৩. সভা-সমাবেশসহ সব গণতান্ত্রিক অধিকার ও জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ আমাদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সীমিত আকারে হলেও সে সুযোগ আমরা নিতে চেয়েছি।
৪. একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সকল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় আমরা বিশ্বাস করি। তাই আমরা নির্বাচনমুখী একটি দল হিসেবে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের জায়গায় জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছি।
৫. একদলীয় শাসন থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিজয়ের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আমরাই সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করি। জনগণের সরাসরি ভোটে সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনের ব্যবস্থাও আমরাই করি। যে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি, সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকাটাই বিএনপি যুক্তিসংগত মনে করেছে।
৬. সর্বোপরি, জনগণের ওপর আমাদের রয়েছে অটুট আস্থা। আমরা মনে করি, দেশের মানুষ সুযোগ পেলেই আমাদেরকে সমর্থন করবে এবং আমাদের সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।
৭. এই নির্বাচনকে আমরা সরকার, শাসক দল, নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য একটি টেস্ট কেস হিসেবেও নিয়েছি।
এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হবে না।
এমন একটি নির্বাচনেও যদি তারা যথাযথ আচরণ না করে, যদি সকল পক্ষের জন্য সুযোগের সমতা সৃষ্টি না করে, যদি নিরাপদ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারে এবং যদি সন্ত্রাস, ডাকাতি, কারচুপির মাধ্যমে তারা জনগণের রায়কে বদলে ফেলে, তাহলে সকলের কাছে আবারো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে, এদের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
সেনা মোতায়েনের দাবি
‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটদান নিশ্চিত করতে’ নির্বাচনী এলাকায় বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনীর পর্যাপ্ত পরিমাণ সদস্য মোতায়েনের দাবি প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এতে ভোট দেওয়া, ভোট গণনা, ফল প্রকাশ এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য সহিংসতাও রোধ করা যায়। কারণ, জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর সকলের আস্থা রয়েছে। বিভিন্ন দেশে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে সাহসিকতার সঙ্গে পালনের ব্যাপারে এই বাহিনী গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য স্থাপন করেছে। নিজের দেশেও তাঁরা সফলভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনো করতে পারবেন বলে আমরা মনে করি।’
‘দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে তাদের ভোট ডাকাতির পরিকল্পনার দোসর হয়ে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের কথা বলে এক ধূর্ত অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তারা প্রথমে বলেছিল, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনের সময়ে ও আগে-পরে মোট চার দিন নির্বাচনী এলাকায় সেনা মোতায়েন থাকবে। পরে তারা তাদের চিঠি বদল করে নতুন সংশোধিত চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সেনা ছাউনিতেই থাকবেন রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে। রিটার্নিং অফিসার প্রয়োজনবোধে ডাকলেই কেবল তাঁরা কোথাও যেতে পারবেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে কাজ করবেন। এটা অর্থহীন এবং পুরোই প্রতারণামূলক,’ যোগ করেন বিএনপির চেয়ারপারসন।
সেনাবাহিনীর প্রতি শেখ হাসিনার আস্থা নেই মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর ওপর যে তাদের কোনো আস্থা নেই, এতে তা আবার প্রমাণিত হলো। প্রমাণিত হলো যে, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি ও কারসাজির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলার এবং ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর যে পরিকল্পনা এঁটেছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে তারা বাধা বলে মনে করছে। আর ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাস ও কারচুপির পরিকল্পনায় সহায়তা দিতেই নির্বাচন কমিশন এ পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে ভোটের দিন এবং আগে-পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোতায়েন করতে আবারো দাবি জানাচ্ছি।’