আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
বিক্ষোভকারীদের সরাসরি গুলির নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় তার সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার’ করার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের ‘যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গুলি করার’ জন্য খোলা নির্দেশ জারি করেছিলেন। শেখ হাসিনার গোপন ফোনকলের রেকর্ড পর্যালোচনা করে কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরা আজ বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আলজাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট (আই ইউনিট) শেখ হাসিনার কথপোকথনের অডিও রেকর্ডটি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছে এবং সেটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য ভয়েস ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে কথপোকথনের অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের কন্ঠস্বরকে শনাক্ত করেছে।
বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) ১৮ জুলাই ধারণ করা একটি কথপোকথনে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় যে, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ওই রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার নির্দেশনা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। আমি পুরোপুরি খোলা নির্দেশ জারি করেছি। এখন তারা (নিরাপত্তা বাহিনী) মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে, তাদের (বিক্ষোভকারী) যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গুলি করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে। আমি এখন পর্যন্ত তাদের থামিয়ে রেখেছি... আমি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলাম।’
পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথাবার্তায় শেখ হাসিনাকে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ব্যবহারের কথা বলতে শোনা যায়। শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেখানেই তারা (নিরাপত্তাবাহিনী) কোনো জনসমাবেশ লক্ষ্য করবে… তা ওপর থেকে দেখা হচ্ছে… বেশ কয়েক জায়গায় এটি শুরু হয়ে গেছে… এই তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। কিছু এলাকায় বিক্ষোভকারীরা সরে গেছে।’

সে সময়ের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর আকাশ থেকে গুলি করার বিষয়টি অস্বীকার করলেও রাজধানী ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরিফ আলজাজিরার আই-ইউনিটকে বলেন, ‘একটি হেলিকপ্টার থেকে আমাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকরা অস্বাভাবিক বুলেটের আঘাতে আহত প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের শুশ্রুষা করেছিলেন।
শাবির শরিফ বলেন, ‘বুলেটগুলো শিক্ষার্থীদের কাঁধ ও বুকের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। সে সময় আমরা এ ধরনের বেশ কিছু রোগী এখানে পেয়েছিলাম। যখন আমরা এক্সরেগুলো দেখছিলাম আমরা অবাক হয়ে যেতাম কেননা সেগুলো ছিল বড় বড় বুলেট।’ তবে আলজাজিরা যাচাই করতে পারেনি সেগুলো কোন ধরনের বুলেট ছিল।
এই ফোনকলগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে কৌঁসুলিরা তুলে ধরতে পারেন। শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়েছে। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা ও দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে এবং আগামী আগস্টে এই মামলার বিচারকাজ শুরু হবে।
শেখ হাসিনার নজরদারি নেটওয়ার্ক এনটিএমসি এইসব আলাপচারিতা রেকর্ড করেছিল। এনটিএমসির বিরুদ্ধে এর আগে কেবলমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই নয়, এমনকি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিত্রদের ওপর নজরদারির অভিযোগ আনা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি (চিফ প্রসিকিউটর) তাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানাতেন যে, তার কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকটি ক্ষেত্রে অন্য প্রান্তের বক্তা বলেছিলেন যে, টেলিফোনে এসব আলোচনা করা উচিত না। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ আমি জানি, আমি জানি, আমি জানি, এটা (কথাবার্তা) রেকর্ড হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি (শখ হাসিনা) অন্যদের জন্য গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনিই সে গর্তে পড়েছেন।’
গণঅভ্যুত্থান চলার সময় ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর শহরে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যুর ঘটনায় অভ্যুত্থান নতুন মোড় নেয় এবং আন্দোলনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়।
ওই ঘটনায় শেখ হাসিনার মিত্র ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একটি ফোন রেকর্ড থেকে শোনা যায় তিনি আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ওই ফোনকলে সালমান রহমানকে সে সময়কার পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে ওই প্রতিবেদনের কী হয়েছিল তা জানতে কথা বলতে শোনা যায়।
রেকর্ডে সালমান এফ রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হতে এতো সময় লাগছে কেন? কে এখানে লুকোচুরি করছে? রংপুর মেডিকেল?’
এ বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম আলজাজিরাকে বলেন, পুলিশ পাঁচবার তাকে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল যাতে তার (আবু সাঈদ) গায়ে একাধিক বুলেটের আঘাতের বিষয়টি না থাকে। ডা. রাজিব বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও তারা (পুলিশ) চেয়েছিল আমি যেন প্রতিবেদনে আবু সাঈদ পাথরের আঘাতে মারা গেছে এমন বর্ণনা দেই।’
আবু সাঈদ মারা যাওয়ার ১২ দিন পরে তার পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় আনা হয় সে সময়কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। এ সময় প্রায় ৪০টি পরিবারকে আনা হয়েছিল। এ বিষয়ে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের গণভবনে আসতে বাধ্য করেছিল। তারা আমাদের জোর করে এনেছিল আর তা না হলে আমাদের ওপর অন্যভাবে নির্যাতন চালানো হতো।’
এদিকে, শেখ হাসিনার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র আলজাজিরার কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছেন, শেখ হাসিনা ‘মারণাস্ত্র’ ব্যবহারের কথা কখনোই বলেননি, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীকে তা ব্যবহারের নির্দেশও দেননি। তিনি বলেন, ফোনকলগুলো সম্পূর্ণ সাজানো।