শিশুরা কেন মিথ্যা বলে?

সাত বছর বয়সী সায়মা খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। প্রাণবন্ত এই শিশুটি সব সময় বুঁদ নিজের কল্পনার জগতে। সমস্যা অন্য, এই জগৎকে নিজের মতো করে মিথ্যা কথা দিয়ে সাজিয়ে রাখে সে। আপাতত এ বিষয় নিয়ে বেশি সমস্যা হয় না যতক্ষণ সে ছবি আঁকে, সারা ঘরে দুষ্টুমি করে বেড়ায়। কিন্তু যখন সে এই মিথ্যা বলা প্রতিনিয়ত শুরু করে, তখন বিষয়টি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠতে থাকে।
সায়মার মা আশা বলেন, ‘সায়মা অনেক ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কল্পনা করত। একা একা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প বানাত। কিন্তু যখন ওকে আমি স্কুলে ভর্তি করি, তখন প্রথম প্রথম বাসায় ফিরে সে বলত যে, ক্লাসের সব প্রশ্নের উত্তর সে একাই দিয়েছে এবং শিক্ষকরা তার ওপর অনেক খুশি। কিন্তু কিছুদিন পরেই স্কুল থেকে বাসায় ফিরে অভিযোগ করতে শুরু করে, কীভাবে সেই একই শিক্ষক সামান্য বিষয়ে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। অথচ আমি যখন তার শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করি, তখন বিষয়টি অন্যভাবে প্রকাশ পায় আমার কাছে। আমি আর ওর বাবা, দুজনেই ওকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, ও কেন এমন মিথ্যা কথা বলছে? তখন সে বলে, সে আমাকে পছন্দ করে না, কারণ চাকরির জন্য আমি তাকে সময় দিতে পারি না। এ কারণেই সে মিথ্যা বলে, নিজের কল্পনার জগৎকে সত্যি মনে করে এবং এককথায় মিথ্যা বলে সে নিজের একাকিত্ব দূর করতে চায়।’
শিশুরা ছোটবেলা থেকেই নিজেদের কল্পনার জগৎ তৈরি করতে থাকে, যা ধীরে ধীরে বড় হয়। সেখানেই সে মিথ্যা কথা সাজিয়ে গল্প বড় বানাতে থাকে। তারা আসলে নিজেরাই জানে না, কেন এমন কল্পনা করছে, কেনই বা মিথ্যা বলছে। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, এ বিষয় তারা ঠিকমতো বুঝতেই পারে না।
অনেক শিশুই মাঝেমধ্যে মিথ্যা বলে, কিন্তু তাদের মিথ্যা বলার প্রবণতা বাড়ার পেছনের কারণে ভিন্নতা রয়েছে :
• শিশুরা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যটাই জানে না। এ ধরনের মিথ্যাগুলো খুব একটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু মা-বাবাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তাঁর বাচ্চা একটু বড় হয়ে স্কুলে যাওয়ার পরও সেই মিথ্যা বলাকে আর অভ্যাসে পরিণত না করে।
• যখন কোনো শিশুকে স্কুলে ভর্তি করা হয়, তখন সে নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়, নতুন একটি পরিবেশে যায়। এ ধরনের পরিবেশে সে যদি কোনো ভুল করে, তাহলে সবার কাছ থেকে সে লুকাতে চায়। ধরা পড়ার ভয়ে সব সময় সে নিজের ভুল স্বীকার করতে অস্বীকার করে।
• যেসব শিশু স্কুলে একটু অবহেলিত থাকে, তারাই সচরাচর মিথ্যা বলে, যাতে সবাই আগ্রহের সঙ্গে তাকে গুরুত্ব দেয়। এসব শিশুকে বোঝাতে হবে, তারা কতটা স্পেশাল আপনার জন্য। এবং এই উপলব্ধি আনতে হবে তাদের মধ্যে যে, আপনি তাঁকে বিশ্বাস করেন।
• আত্মবিশ্বাসের অভাব ও অনিশ্চয়তার কারণেও অনেক সময় শিশুরা মিথ্যা বলে।
শিশুদের মিথ্যা বলার অভ্যাস দূর করবেন যেভাবে :
• অনেক সময় শিশুরা তাদের মা-বাবার কারণেও মিথ্যা বলে। এর কারণ হলো, তারা দেখে তাদের মা-বাবাও নানা মিথ্যা বলছে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে; এমনকি কর্মজীবনেও! সেই মিথ্যার প্রভাবটিই তাদের সন্তানের ওপর পড়ে। শিশুরা চিন্তা করে, যদি মা-বাবা এমন বলতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না? তাই শিশুদের সামনে যতটা সম্ভব মিথ্যা কথা এড়িয়ে চলুন।
• শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সত্য-মিথ্যার পার্থক্য শেখানোর চেষ্টা করুন। তাদের মিথ্যা শুনুন, একটা বয়সের পর শিশুর কাছে মিথ্যার ক্ষতির দিকটা তুলে ধরুন।
• মিথ্যা বলা রাখাল বালকের গল্প, কাঠঠোকরার গল্প—এ ধরনের গল্প ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শোনাতে থাকবেন। এতে করে তারা শিখতে পারবে, মিথ্যা বলার কারণে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে।
• অনেক সময় শিশুরা মিথ্যা বললে মা-বাবা বিষয়টি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। এমনকি হেসে উড়িয়ে দেন। এ বিষয়টি তাদের সন্তানের মিথ্যা বলার প্রবণতাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই শিশুরা কোনো সামান্য বিষয়ে মিথ্যা বললে তাকে শাসন করুন, যাতে মিথ্যা বললে বকা শুনতে হবে, সেই অনুভূতি তার মধ্যে তৈরি হয়।
• সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন। কেন সে মিথ্যা বলছে এবং কী কারণে সত্যটাকে সে লুকিয়ে রাখতে চায়, এটা আপনার জানতে হবে। তবে রাগারাগি করে নয়, বুঝিয়ে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করুন।
• শিশুদের প্রতিটি ভালো কাজের জন্য তাকে বাহবা দিন এবং সত্য বলার জন্য উপহার দিন। তাহলে তার মধ্যে মিথ্যার বদলে সত্য বলার ইচ্ছা তৈরি হবে।
• শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই মা-বাবার কাছ থেকে দেখে শেখার চেষ্টা করে। তারা ছোটবেলা থেকে তা-ই শেখে, যা তারা চোখের সামনে দেখে। তাই যেকোনো আচরণ করার আগে মা-বাবার সতর্ক থাকা উচিত।