নতুন ৬০ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে : জাতিসংঘ

মিয়ানমারের সহিংসতাপ্রবণ রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-ধর্ষণ-নির্যাতনের মুখে নদী ও সমুদ্রপথে বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান নিঃস্ব অবস্থায় বাংলাদেশের উপকূলবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
বিপুল এই জনগোষ্ঠীর চাপ সামলানো স্থানীয় জনগণ এবং দাতা সংস্থাগুলোর জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ওপর আবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যবর্তী নো-ম্যানস ল্যান্ডে আটকে আছে আরো অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা।
এর আগে গত বছরের অক্টোবরে সহিংসতার পর ৯০ হাজার মানুষ এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এ ছাড়া গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদের অনেকেই উপকূলের বিভিন্ন নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অবস্থান করছে। কিছু রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিশেষত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের উপস্থিতি বেশি।
এরই মধ্যে মিয়ানমার থেকে নতুন করে আসা হাজারো রোহিঙ্গাকে সহায়তা করছে জাতিসংঘ। তবে সব মিলিয়ে একটা মানবিক বিপর্যয়েরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। কক্সবাজারে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু তথ্য নিয়ে সেখানকার পরিস্থিতির এমন বর্ণনাই দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে।
জাতিসংঘ গত শুক্রবার তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দুজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক। এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘ এক সপ্তাহে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য দিয়েছিল। কিন্তু দিন দিনই এই সংখ্যা বাড়ছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কর্মরত দাতা সংস্থার কর্মীরা জানান, জরুরি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী যেমন সুপেয় পানি, খাবারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের অস্থায়ী আবাসস্থল বা শরণার্থী শিবিরগুলো মানুষে ভরে গেছে। এর ফলে নতুন আসা শরণার্থীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যা একটি গুরুতর সমস্যা।
এই শরণার্থীদের জন্য মজুদ থাকা শুধুমাত্র উচ্চশক্তিসম্পন্ন বিস্কুটই যথেষ্ট নয়। এদের জন্য ভাতের ব্যবস্থা করাও দাতা সংস্থার কর্মীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ।
পালিয়ে আসা এসব মানুষের সঙ্গে থাকা প্রায় ১৬ হাজার স্কুলগামী শিশু এবং পাঁচ হাজার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। এসব শিশুর অধিকাংশই পালিয়ে আসার ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেই সঙ্গে এরা ক্ষুধার্তও বটে। অতিসত্বর তাদের জন্য শুকনো খাবার এবং মনো-সামাজিক সহায়তা প্রয়োজন।
এই মুহূর্তে ওই এলাকায় একসঙ্গে পাঁচ হাজারেরও বেশি শিশুকে শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে অন্তত ৫০০টি স্কুল বা শিক্ষাকেন্দ্র খোলা প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন রোধ করতে শিশুশ্রম, যৌন হেনস্তা, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং মানবপাচারের কুফল সম্পর্কে এসব পালিয়ে আসা মানুষকে জানাতে হবে। যাতে তারা নিজেরাই এসব রোধ করতে পারে।
একসঙ্গে প্রচুর মানুষ দেশে ঢোকার কারণে গর্ভবর্তী নারী, শিশু বা বৃদ্ধরা ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। স্যানিটেশন এবং সুপের পানির ব্যবস্থা করা এই মুহূর্তে দাতব্য সংস্থার কর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
পালিয়ে আসাদের মধ্যে কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট নৌকায় করে নদী ও সমুদ্রপথে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এ পর্যন্ত নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৪০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবু শরণার্থী মানুষের ঢল কমছে না।
জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে দেশটির উত্তর-পূর্ব রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। জাতিগতভাবে নির্মূল করতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের গ্রামে আগুন দিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াসহ গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সহিংসতার শিকার হয়ে গত বছরের অক্টোবরে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
এর আগে ২০১২ সালের জুনেও রাখাইন রাজ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছিল। তখন প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হন। ওই সময় দাঙ্গার কবলে পড়ে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।