গাজায় হামলা ঘিরে বিভক্ত ইসরায়েল, বাড়ছে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ

গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক হামলা অব্যাহত থাকায় দেশটির অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন আরও গভীরতর হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধে সম্পূর্ণ জয় অর্জনের ওপর জোর দেওয়ায়, একদিকে শান্তিকামী আন্দোলন জোরালো হচ্ছে, অন্যদিকে যুদ্ধপন্থীদের অবস্থানও আরও কঠোর হয়ে উঠছে। খবর আল জাজিরার।
গত কয়েক সপ্তাহে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা খোলা চিঠিতে যুদ্ধের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করেছেন, গাজা ধ্বংস করার মাধ্যমে ইসরায়েলি জিম্মিদের জীবন আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে।
ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকরাও যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার বিষয়টি সামনে এনেছেন। তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ার আহ্বানে একটি বৃহৎ আন্দোলন গড়ে উঠেছে—যা ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
এ অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ ইহুদি ইসরায়েলি চায় গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিতে এবং প্রায় ৫০ শতাংশ “শত্রু শহরে বেসামরিক মানুষদের গণহত্যা” সমর্থন করেন।
সোমবার জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের নেতৃত্বে হাজারো ইসরায়েলি পূর্ব জেরুজালেমের পুরনো শহরে “আরবদের মৃত্যু হোক” স্লোগান দিয়ে মিছিল করে এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়। মিছিলের মঞ্চে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচও, যিনি ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের ঘোর সমর্থক।
তিনি জনতাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আমরা কি জয়ের ভয় পাই? দখলের শব্দটি শুনলে কি আমরা কেঁপে উঠি?” উত্তরে জনতা প্রবলভাবে ‘না’ বলে চিৎকার করে।
গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে ইতোমধ্যে ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মাঝেই এপ্রিল মাসে এক হাজারের বেশি সক্রিয় ও সাবেক পাইলট যুদ্ধের বিরুদ্ধে খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর আরও চিঠি ও তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগ না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলের বামপন্থী ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা ইয়ায়ার গোলান যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেন, ইসরায়েল এখন “শিশু হত্যা করছে শখের বসে” এবং “জনগোষ্ঠী উচ্ছেদের লক্ষ্য” নিয়েছে। তিনি সতর্ক করেন, এভাবে চলতে থাকলে ইসরায়েল একটি “ঘৃণিত রাষ্ট্র” হয়ে উঠবে।
গোলান ও যুদ্ধবিরোধী সংসদ সদস্য ওফার কাসিফ দক্ষিণ ইসরায়েলে একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গেলে ডানপন্থী দর্শকদের রোষানলে পড়েন এবং নিরাপত্তারক্ষীদের সহায়তায় বের করে আনা হয়।
কাসিফ বলেন, “শান্তিকামীদের জন্য এখন ইসরায়েলে টিকে থাকাই কঠিন। আমাকে রাস্তায় হাঁটতে গেলে আক্রমণ করা হয়। এমনকি জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরাও চরমপন্থীদের হুমকির মুখে।”
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইহুদা শেনহাভ-শারাবানি বলেন, “এটা কেবল বাম বনাম ডানের লড়াই নয়। এটা দুইটি সিয়োনিস্ট এলিটের মধ্যে কে বেশি ফ্যাসিস্ট, সেই প্রতিযোগিতা।”
তিনি বলেন, “একদিকে আছে ঐতিহ্যবাহী আশকেনাজি ইহুদিরা—যারা ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করেছে, দখল বজায় রেখেছে, হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে। অন্যদিকে আছে বর্তমান ধর্মীয় চরমপন্থীরা, যাদের তারা এখন ফ্যাসিস্ট বলে অভিহিত করছে। কিন্তু সত্যি হলো—উভয় পক্ষই গাজায় গণহত্যার ব্যাপারে উদাসীন।”

যখন গাজায় আগ্রাসন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনই পশ্চিম তীরেও বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। ৪০ হাজার ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে সেখানে সামরিক নেটওয়ার্ক বসাচ্ছে তারা। বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ও অর্থমন্ত্রী স্মোটরিচ নতুন করে ২২টি বসতি স্থাপনের ঘোষণা দেন—যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
স্মোটরিচ এর আগেও বলেছেন, গাজা “সম্পূর্ণ ধ্বংস” করা হবে এবং ফিলিস্তিনিদের একটি ছোট এলাকায় ঠেলে দেওয়া হবে।
প্রফেসর শেনহাভ-শারাবানি শেষ কথা বলেন, “১৯৯৪ সালে আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলাম। এক ইহুদি বিচারপতি আমাকে বলেছিলেন—ফিলিস্তিনিদের মুক্তি তখনই আসবে, যখন ইসরায়েলিরা তাদের জন্য জেল খাটতে প্রস্তুত হবে। আমরা এখনও সেই জায়গায় পৌঁছাইনি।”