ভারত মুসলিমদের জোর করে বাংলাদেশে পুশইন করছে : এইচআরডব্লিউ

ভারতের সরকার রাজনৈতিক লাভের জন্য মুসলিমদের নিশানা করছে। শত শত বাংলাভাষী মুসলিমকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে, এমনটাই অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) প্রকাশিত তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
এইচআরডব্লিউ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, গত ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ মুসলিম পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে ভারত থেকে জোর করে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেককে মারধর করা হয়েছে, তাদের ভারতীয় পরিচয়পত্র ছিঁড়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ভারত সরকার কতজনকে এভাবে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেই বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
এনজিওটির এশিয়া পরিচালক এলেন পিয়ারসন বলেছেন, ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) ভারতীয় নাগরিকসহ বাংলাভাষী মুসলিমদের নির্বিচারে দেশ থেকে বের করে দিয়ে বৈষম্যকে উসকে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার অবৈধ অভিবাসীদের ধরার নামে হাজার হাজার দুর্বল মানুষকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, কিন্তু তাদের এসব কাজ আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বৈষম্যমূলক নীতির অংশ।
অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে মোদির অভিযান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনের আগে জনসভায় তিনি প্রায়ই বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ওপর জোর দিয়েছেন ও তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর একটি মারাত্মক হামলার পর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মে মাসে রাজ্যগুলোকে নির্দেশ দেয়, তারা যেন ৩০ দিনের মধ্যে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের আটক করে। নয়াদিল্লি দাবি করেছে, সব বহিষ্কারই অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে করা হয়েছে।
তবে এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনে এই তড়িঘড়ি অভিযানের নিন্দা করে বলা হয়েছে, সরকারের এই কারণ ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’। কারণ, এটি ‘সঠিক আইনি প্রক্রিয়া, অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম’ উপেক্ষা করেছে। পিয়ারসন বলেন, ‘সরকার রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করতে গিয়ে আশ্রিতদের আশ্রয় দেওয়ার ভারতের দীর্ঘ ঐতিহ্যকে খাটো করছে।’
মে মাসে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছিল, কর্তৃপক্ষ প্রায় ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জোর করে আটক করে নৌবাহিনীর জাহাজে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ফেলে দিয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এটিকে ‘সুন্দরভাবে তৈরি গল্প’ বললেও মোদি সরকার এখনও প্রকাশ্যে এই অভিযোগ অস্বীকার করেনি।
মুসলিম অভিবাসী কর্মীদের নিশানা
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, যারা ভারত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের মধ্যে কিছু বাংলাদেশী নাগরিক থাকলেও অনেকেই ভারতীয় নাগরিক, যারা প্রতিবেশী রাজ্য থেকে আসা বাংলাভাষী মুসলিম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ সঠিক আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই দ্রুত বহিষ্কারের কাজ করেছে, যেখানে বহিষ্কারের আগে ব্যক্তির নাগরিকত্ব যাচাই করা হয়নি।
বহিষ্কৃতদের মধ্যে ৩০০ জন এসেছেন পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম থেকে, যেখানে একটি বিতর্কিত নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া চালু আছে। বাকিরা ছিলেন বাংলাভাষী মুসলিম, যারা কাজের সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা ও দিল্লিতে গিয়েছিলেন।
বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করা মোদির বিজেপি ও তাদের সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে ভারতে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের অভিবাসনের বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখনও জয়ী হতে পারেনি, সেখানে ২০২৬ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, তারা এক ডজনেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশে বহিষ্কারের পর আবার ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে এমন ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

পাঁচ বছর ধরে ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাইতে বসবাস করা পশ্চিমবঙ্গের একজন অভিবাসী শ্রমিক নাজিমুদ্দিন শেখ বলেছেন, পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে, তার ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণকারী পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলেছে ও তাকে ১০০ জনেরও বেশি লোকের সাথে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা বেশি কথা বললে তারা আমাদের মারধর করে। তারা আমার পিঠে ও হাতে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। তারা আমাদের মারধর করছিল ও আমাদের বলতে বলছিল, আমরা বাংলাদেশি।
আসামের আরেক কর্মী তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বলেন, আমি লাশের মতো বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে মেরে ফেলবে, কারণ তাদের হাতে বন্দুক ছিল ও আমার পরিবারের কেউ জানতে পারবে না।