লতার এক হাতে হাজারো প্রাণের দায়িত্ব, আরেক হাতে সংসার

স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার সিগন্যাল পেতেই এদিক-সেদিক উঁকিঝুঁকি। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নামালেন রেললাইনের ভারি লোহার গেট। গেটের দু’পাশে অপেক্ষায় পথচারীরা। এরপর ডানহাতে সবুজ পতাকা শক্ত করে ধরে সোজা দাঁড়িয়ে থাকলেন। মুহূর্তেই একটি ট্রেন দ্রুত চলে গেল। এরপর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ফের গেট তুলে দেন গেটম্যান লতিফা ইসলাম লতা (৩৪)।
গতকাল শুক্রবার (৭ মার্চ) দুপুর ১২ টা ৪৭ মিনিটে কু্ষ্টিয়া-রাজবাড়ী রেললাইনের কুমারখালী কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় এ দৃশ্য দেখা যায়।
লতা ২০২০ সাল থেকে কুমারখালী পৌরসভার কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় গেটম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তাঁর একহাতে শক্ত করে পতাকা ধরে হাজারো মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। আরেক হাতে তাঁর স্বামী, তিন সন্তান ও সংসারের দাঁয়িত্বও পালন করছেন। স্বামীকে সহযোগিতা ও নিজেকে স্বাবলম্বী করতে এবং সন্তানদের মানুষ করতে দুই হাতে দুই বড় দায়িত্ব সমান তালে চালিয়ে নিচ্ছেন।

লতিফা ইসলাম লতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সিমরাইলকান্দি এলাকার বালু ব্যবসায়ী মো. আফসানুর ভূঁইয়ার স্ত্রী। তিন সন্তানসহ তিনি কুমারখালী পৌরসভার কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় ভাড়া থাকেন তারা। মাঝেমধ্যে তাঁর স্বামী কুমারখালীতে আসেন।
আলাপকালে গেটম্যান লতিফা ইসলাম লতা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও হাজারো প্রাণের নিরাপত্তার জন্য দিনে পালাক্রমে আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছি। মূলত স্বামীকে সহযোগিতা ও নিজেকে স্বাবলম্বী করতে এবং সন্তানদের মানুষ করতে দুই হাতে বড় দুই দায়িত্ব সমান তালে চালিয়ে নিচ্ছি। নারী হিসেবে এমন কাজ করায় কেউ কেউ খারাপ মন্তব্য করে। আবার অনেকে ভালোও বলে।’ সবমিলিয়েই চলে যাচ্ছে বলে একগাল মুচকি হাসি দেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেল ক্রসিংয়ের মান উন্নয়ন প্রোজেক্টের আওতায় ২০২০ সালে রেললাইনের গেটম্যান বা গেটকিপারের চাকরিতে যোগ দেন লতা। এর আগে তিনি ঢাকাতে একটি শিল্প কারখানায় চাকরি করতেন। তাঁর স্বামী ব্যবসায়ীর কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে থাকেন। আর তিনি সন্তানদের নিয়ে ভাড়া বাড়িতে কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় বাস করেন। বড় ও ছোট ছেলে স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আর সাত মাস বয়সি ছোট আরফান মায়ের সঙ্গেই থাকে। যখন ট্রেন আসার সময় হয় তখন শিশু ছেলেকে বিভিন্নজনের কাছে রেখে দায়িত্ব পালন করেন লতা।
লতার স্বামী আফসানুর ভূঁইয়া ফোনে বলেন, ‘আমার স্ত্রী একজন কর্মঠ ও আদর্শিক নারী। সময় সুযোগ পেলে তার কাজে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। তাকে নিয়ে আমি গর্বিত।’

জানতে চাইলে লতার সহকর্মী আরেক গেটম্যান রাজিব হোসেন বলেন, ‘জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার জন্যে আমরা তিনজন পালাক্রমে আট ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছি। তিনজনের মধ্যে একজন নারী। ঝুঁকি আছে জেনেও লোকের কটুকথা শুনে লতা আপা কাজ করছে। আমরা তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।’
স্থানীয় বাসিন্দা প্রসেনজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় একজন নারী কিপার সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি (লতা) সংসারের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। সমাজে তিনি একজন আদর্শিক নারী। তার থেকে অন্যান্য নারীদের শেখার আছে।’
বিকেলে কাজীপাড়া রেলগেট এলাকার আতিকুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সাত মাসের সন্তানকে বিছানায় রেখে সংসারের কাজ সেরে নিচ্ছেন লতা। এ সময় তিনি বলেন, ‘চাকরি করলেও আমিতো কারো স্ত্রী, কারো মা। একটা সংসার আছে। সবকিছুই মিলেই করতে হয়। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও চাকরিতে কোনো ছুটি নেই, আবার বেতন কম।’ তিনি বেতন বাড়ানো ও ছুটি ঘোষণার দাবি জানান।
লতা শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করছেন জানিয়ে কুমারখালী রেলস্টেশন মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন নারী-পুরুষের সমান অধিকার। ঝুঁকি জেনেও নারীরা এখন অনেক কাজ দক্ষভাবে করছেন।’