৪ ডাক্তারে চলছে ৫ লাখ মানুষের চিকিৎসা, বন্ধ অ্যাম্বুলেন্স সেবা

নওগাঁর সবচেয়ে বড় উপজেলা মান্দা। প্রায় ৫ লাখ মানুষের এই উপজেলায় ৫০ শয্যার একটি মাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অথচ এই হাসপাতালে চিকিৎসক থাকার কথা ২৪ জন, কর্মরত আছেন মাত্র চারজন। হাসপাতালে থাকা দুটি অ্যাম্বুলেন্স এক বছরের বেশি সময় ধরে চালক না থাকায় গ্যারেজেই পড়ে রয়েছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালে চারজন চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও)। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ১০ জন, সাধারণ চিকিৎসক ১০ জন ও মেডিকেল অফিসার একজনসহ ২১টি পদই শূন্য। এছাড়া, সাময়িকভাবে আনা হয়েছে সাতজন উপসহকারী মেডিকেল অফিসার। চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি নার্স, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার, ওটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরও ঘাটতি রয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ জন। মাত্র দুটি কক্ষে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। হাসপাতালের দুটি অ্যাম্বুলেন্স দীর্ঘদিন ধরে গ্যারেজে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে আউটডোরে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন এবং ইমার্জেন্সি ও ইনডোরে ১৩০ থেকে ১৪০ জন রোগী চিকিৎসা নেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা না মেলায় উপজেলার মানুষ অতিরিক্ত টাকা খরচ করে স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিংবা জটিল রোগীরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) ও নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ থাকায় রোগীদের রাজশাহী কিংবা নওগাঁতে আসা-যাওয়া করতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে।
সেবা নিতে আসা উপজেলার বিজয়পুর গ্রামের মমতাজ বিবি ও রূপালী বেগম, ছোট বেলালদহ গ্রামের ইসাহাক আলী মোল্লা, বড়পই গ্রামের সাথী আক্তারসহ ৭-৮ জনের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, হাসপাতালে আর আগের মতো চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। ঘণ্টার ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে সেবা না নিয়েই অনেক সময় ফিরে যেতে হয়। তাদের অভিযোগ, এখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের (প্রেসক্রিপশন) বেশির ভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়।
উপজেলার কশব ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী শামীম হোসেন বলেন, বুকের ব্যথার চিকিৎসা নিতে আমি ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু এখানে টিকিট কেটে একজন ডাক্তারকে দেখানোর পর তিনি কোনো চিকিৎসা না দিয়ে হার্টের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে বললেন। ভালো ডাক্তার না থাকায় এখন আমাকে রাজশাহী কিংবা নওগাঁতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
উপজেলার সতীহাট এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুজ্জামান সেতু বলেন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু না থাকায় রোগীদের বাড়তি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স মান্দা থেকে রাজশাহী কিংবা নওগাঁয় যেতে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হতো। সেখানে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হচ্ছে। চালকের অভাবে লাখ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্স অব্যাহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা খুবই হতাশাজনক। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অবহেলার কারণে এটা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তাসনিম হোসাইন আরিফ বলেন, এই হাসপাতালে বর্তমানে মাত্র চারজন চিকিৎসক আছেন। এর মধ্যে আমি একজন আরএমও। মূলত এই চারজন দিয়েই পুরো হাসপাতালের আউটডোর, ইনডোর, ইমার্জেন্সি, অপারেশনসহ সবকিছু চালাতে হচ্ছে। একদিকে চিকিৎসক সংকট, অন্যদিকে হাসপাতালের দুটি অ্যাম্বুলেন্স চালক না থাকায় দীর্ঘ এক বছর ধরে পড়ে আছে। যে চালক ছিলেন তিনি অবসরে গেছেন। নতুন কাউকে দেওয়া হয়নি। এছাড়াও জ্বালানির (তেল) বরাদ্দও নেই। আমরা অনেকবার লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোনো সাড়া মেলেনি।

মান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমরা মাত্র চার জন চিকিৎসক দিয়ে জরুরি ও ইনডোর চালিয়ে নিচ্ছি। যদিও আমাদের এখানে চিকিৎসক পদের সংখ্যা ২৪টি। আমি অনেকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। শুধু চিকিৎসক নয়, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার, ওটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স চালানোর জন্য তেল বরাদ্দও নেই। বিষয়গুলো আমরা নিয়মিত জানিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, শীঘ্রই সমাধান হবে।
নওগাঁর ডেপুটি সিভিল সার্জন মুনীর আলী আকন্দ বলেন, বর্তমানে চিকিৎসক সংকট শুধু মান্দায় নয়, গোটা জেলাতেই। আমরা বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। একইসাথে মান্দা হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক নিয়োগেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি, দ্রুত সমাধান হবে।