২৯ জুলাই ২০২৪
ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল সারা দেশ, পুলিশের বাধা-গ্রেপ্তার

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই (সোমবার) দেশজুড়ে এক অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। তারা মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের ঘোষণা দেয়, যা ছিল সরকারের ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যানের একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। সেদিনই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার গণমাধ্যমকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জানান, হত্যা ও নির্যাতনের বিচার না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিষ্ঠুর উপহাস করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদেই এই কর্মসূচি নেওয়া হয়, যেখানে ৩০ জুলাই (মঙ্গলবার) মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে তা অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবির কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এই কর্মসূচি ঘোষণার পর সোমবার দিবাগত রাত ১২টা থেকেই শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নিতে শুরু করে। অনেক তারকাও তাদের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করেন।
আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংসদে আইন পাসসহ তিন দফা দাবিতে গত শনিবার (২৭ জুলাই ২০২৪) ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সোমবার দেশজুড়ে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচি পালন করা হয়, যেখানে অগ্নিঝরা প্রতিবাদ ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে রাজধানীর পলাশীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি কর্মসূচির সময় কার্টুনিস্ট ও চারুকলার শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধার মুখে পড়েন ও পুলিশ তাদের রংতুলি জব্দ করে। একই ধরনের ঘটনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও ঘটে।
দেয়ালগুলোতে লেখা হয়— ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন?’, ‘আমার ভাইদের মারলি কেন?’, ‘৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি’ ইত্যাদি। গ্রাফিতিতে ছাদে গুলিতে নিহত ছোট্ট রিয়া এবং আবু সাঈদের প্রতীকী ছবিও স্থান পায়।
এদিকে সোমবার দুপুরে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মঙ্গলবার দেশব্যাপী শোক পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শোক পালনের অংশ হিসেবে কালো ব্যাজ ধারণ ও সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করার কথা জানানো হয়।
আন্দোলনকারীদের আটক ও বিতর্কিত পরিস্থিতি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের ‘জিম্মি’ করে বিবৃতি আদায়ের প্রতিবাদে সোমবার দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা অবস্থায় রোববার (২৮ জুলাই, ২০২৪) রাতে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম একটি ভিডিও বার্তা দেন, যেখানে তিনি কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। তবে অন্য দুইজন সমন্বয়ক অভিযোগ করেন, নাহিদকে নির্যাতনের মুখে এই বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে। ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের কয়েকজনের পরিবার ডিবি কার্যালয়ে গেলেও তাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। একইদিন ভোরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে মিরপুরের একটি বাসার গেট ভেঙে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরে রোববার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ আটক সমন্বয়কদের সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে ছবি প্রকাশ করেন, যা নিয়ে হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, এটি জাতির সঙ্গে মশকরা। ট্রানপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ডিবি’র এই ঘটনাকে ‘অনৈতিক’ ও ‘গর্হিত অপরাধ’ উল্লেখ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টার অভিযোগ তোলে।
আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় সারা দেশে সোমবার ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ ঘোষণা করেন। সমন্বয়কদের জিম্মি ও নির্যাতন করে বিবৃতি দেওয়ার প্রতিবাদে পরদিন ২৯ জুলাই (সোমবার) আবারও রাজপথে আসার ঘোষণা দেয় দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানায়, ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
দশম দিনের মতো দেশে কারফিউ অব্যাহত থাকে, যদিও দিনের বেলার কারফিউ শিথিল করার সময়সীমা বাড়ানো হয়। সোমবার সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) হেলিকপ্টার ব্যবহার করে টহল দেয় ও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও বিভিন্ন সড়কে টহল দিতে দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশ মাইকিং করে কাউকে এক জায়গায় জড়ো না হওয়ার হুঁশিয়ারিও দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও মাঠে অবস্থান করেন। সোমবার অফিস-আদালতে স্বাভাবিক কাজকর্ম হয় ও রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার পরিবেশ প্রায় স্বাভাবিক ছিল। অধিকাংশ সড়কে যানবাহন চলাচলও স্বাভাবিক ছিল।
সরকার, আন্তর্জাতিক মহল ও অন্যান্য সংগঠনের প্রতিক্রিয়া
রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উদ্বেগ সরকার লক্ষ্য করেছে। তবে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য সরকার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা নিরসনে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানান। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কারফিউ জারি ও নাশকতাকারীদের গুলি করার নির্দেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথাও উল্লেখ করেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহত পুলিশ ও অন্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এর আগে গণভবনে আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ ৩৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
এদিকে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত ছিল। রোববার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ১০ হাজার ২৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদিন রাজধানীতে সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় আরও ২২টি মামলা হয়, মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৯ ও গ্রেপ্তার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ৭৬৪ জনে। রোববার সচিবালয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছেন। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের দেওয়া সংখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করে গণমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি বলে দাবি করেন।
রাতে গণভবনে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকে ১৪ দলের নেতারা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে একমত হন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মৃত্যু, গুলিবর্ষণ, গ্রেপ্তারসহ নির্যাতনের নানা ঘটনার সত্য উদঘাটনে ‘জাতীয় গণতদন্ত কমিশন’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা ও বাংলাদেশ জাসদ হতাহতদের তালিকা প্রকাশ ও হত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি করে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, মামলা ও গ্রেপ্তার চলতে পারে না’ বলে মন্তব্য করা হয়। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত শতাধিক শিক্ষক চলমান ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই মাসের ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে হত্যা-গুম-গণগ্রেপ্তার বন্ধ ও আটককৃতদের মুক্তির দাবি জানান। জাতিসংঘ এই ঘটনার তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে।