রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো পোড়াচ্ছে কারা?

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একের পর এক গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। শত বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাস করে আসা পৈতৃক ভিটাবাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা এরই মধ্যে বাংলাদেশে এসেছে। আশ্রয়ের অপেক্ষায় আরো লাখো রোহিঙ্গা।
কিন্তু মিয়ানমারের প্রশাসন বরাবরই যেসব রোহিঙ্গা স্বদেশভূমি ত্যাগ করে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনতার ক্রমাগত অত্যাচার ও মানবাধিকারের লঙ্ঘনের কথা বললেও মিয়ানমারের সরকার ও প্রশাসন বলছে ভিন্ন কথা।
পরে বিবিসির সাংবাদিকরা মিয়ানমারের মংডুর হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে গিয়ে এই নারীর দেখা যান। ছবি : বিবিসি
সম্প্রতি সারা বিশ্বে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যাচারের খবরে নিন্দা জানানো পর দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের একটি দলকে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানায়। ওই দলে ছিলেন বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান জনাথন হেড।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ ঘুরে এসে জনাথন তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, মংডুর একটি স্কুলে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেটি এখন ঘরহারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষে পূর্ণ। তারা বিবিসির সঙ্গে আলাপচারিতায় জানায়, তাদের ওপর মুসলিম ধর্মাবলম্বী সন্ত্রাসীদের আক্রমণের কথা। কীভাবে রোহিঙ্গারা তাদের ঘরে আগুন দিয়ে বিতাড়িত করেছে।
একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছেন রোহিঙ্গারা নিজেই নিজেদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছেন। ছবি : বিবিসি
কিন্তু খুবই অদ্ভুতভাবে যেসব হিন্দু মংডুর ওই একই এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে তারা স্পষ্টই জানালেন, তাদের ওপর রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আক্রমণ করছে, কারণ মুসলিম রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিল আছে তাঁদের।
মংডুর স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিবিসির প্রতিবেদকের কাছে গোপনে জানিয়েছিলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁদের চারপাশে সশস্ত্র পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা আছেন। তাই তাঁরা চাইলেও কথা বলতে পারবেন না। আরেকজন তাঁদের গ্রামে সেনাদের গুলির ঘটনার বর্ণনা দেওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এক প্রতিবেশী তাঁকে চটজলদি থামিয়ে দেন।
মংডুর সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ফোনে টিন্টে জানালেন যেসব বাড়িঘরে আগুন লেগেছে তিনি শতভাগ নিশ্চিত রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। ছবি : বিবিসি
এদিকে মিয়ানমারের প্রশাসনের তরফে সাংবাদিকদের কাছে কিছু ছবি সরবরাহ করা হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে, একদল মানুষ একটি ছনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছেন। ওই ছবিটি প্রচার করে দেশটির প্রশাসন দাবি করে, নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন লাগিয়ে বাংলাদেশে চলে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
বিবিসির অনুসন্ধানী দল ওই ছবিতে লেসওয়ালা কমলা রঙের ব্লাউজ ও স্থানীয় লুঙ্গি পরিহিত এক নারীকে শনাক্ত করে। ওই নারীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দেখানো ভিডিওতে রোহিঙ্গা নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আরো জানানো হয়, ওই নারী নিজের বাড়িতে আগুন দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন। অথচ বিবিসির সাংবাদিকরা ওই নারীকে মংডুর বিদ্যালয়ে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রে দেখতে পান। এ ছাড়া ঘরে আগুন দেওয়ার ওই ভিডিওতে থাকা আরেক পুরুষ যিনি টুপি পরিহিত ছিলেন তাঁকেও ওই আশ্রয়কেন্দ্রে শনাক্ত করেন বিবিসির সাংবাদিকরা। তাঁরা এই ভুয়া ছবিগুলো বানিয়েছিলেন, যাতে মনে হয় মুসলমানরা এই অগ্নিকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
মংডুতে অগ্নিকাণ্ডের এক সপ্তাহ পরের ছবি। এখনো পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। ছবি : বিবিসি
মিয়ানমারের ওই রাষ্ট্রীয় পরিদর্শনের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের একটি বৌদ্ধ মঠে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এক জ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বারবার বলছিলেন রোহিঙ্গাদের ‘অত্যাচার নির্যাতনের’ কথা। তিনি জানান, স্থানীয়দের ওপর কীভাবে ‘নির্যাতন চালায়’ রোহিঙ্গারা। কীভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর ‘নির্যাতন ও লুটতরাজ চালিয়ে’ শেষে নিজেদের ‘ঘরবাড়ি পুড়িয়ে’ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।
এরপর গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদল সীমান্ত নিরাপত্তাবিষয়ক স্থানীয় মন্ত্রী ফোনে টিন্টের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কীভাবে ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ তথা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তাঁরা স্থানীয় জনগণকে জোর করছে প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যকে আরসার দুর্বৃত্তদের বাহিনীতে যোগ দিতে। যারা রাজি হয়নি, তাদের প্রত্যেকের ঘরে আগুন দিয়ে তাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিয়েছে আরসার সদস্যরা। এ ছাড়া এই ‘জঙ্গিরা’ মাইন পুঁতে তিনটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে বলেও দাবি করেছেন টিন্টে।
রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ‘গাও দু থার আ’ এলাকার একটি বাড়িতে আগুন জ্বলছে। ছবি : বিবিসি
এ সময় বিবিসির সাংবাদিকরা টিন্টেকে প্রশ্ন করেন, এই গ্রামগুলো কি সবই আরসার সদস্যরাই পুড়িয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, এটা শতভাগ নিশ্চিত। এ সময় সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিষয়ে প্রশ্ন করলে পুরো বিষয়টিকেই ভিত্তিহীন বলে বাতিল করে দেন টিন্টে। তিনি সাংবাদিকদের কাছে পাল্টা জানতে চান, আপনারা যে কথা বলছেন এর প্রমাণ কী? তিনি আরো বলেন, ‘যারা এসব অভিযোগ করছেন তাঁদের বলছি- ‘কেউ কি তাঁদের (রোহিঙ্গা) ধর্ষণ করতে চাইবে?’
এদিকে যে অল্প কয়েকজন রোহিঙ্গাকে মংডুতে দেখা গেছে, তাঁদের বেশির ভাগই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। এক-দুজন যাঁদের সঙ্গে কথা বলা গেছে তাঁরা জানালেন, সবাই বাংলাদেশে চলে যেতে চান। কিন্তু মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের আটকে রেখেছে। তাঁরা আরো জানান, খাদ্যসংকট এবং ক্রমাগত ভয় নিয়ে বেঁচে আছেন তাঁরা।
এক রোহিঙ্গা তরুণ জানান, তাঁরা সবাই বাংলাদেশে চলে যেতে চান কিন্তু তাঁদের নেতারা প্রশাসনের সঙ্গে থেকে যাওয়ার চুক্তিতে সই করেছেন। মংগডুর বাঙালি মার্কেটে এক রোহিঙ্গা প্রতিবেদককে জানান, মিয়ানমার সরকারকেই মূল ভয় তাঁদের।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাঁদের প্রতিবেদনে একটি গ্রামের ছবিও দেখায়, যে গ্রামটিতে সদ্যই আগুন দেওয়া হয়েছিল। বিবিসি তাদের ভিডিও প্রতিবেদনে জানায়, রাষ্ট্রীয় পরিদর্শনের পরিকল্পনার মধ্যে এই সফর অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ‘গাও দু থার আ’ এলাকার একটি বাড়িতে আগুন জ্বলছে। পালিয়ে গেছেন ওই গ্রামের সব বাসিন্দা। ছবি : বিবিসি
ভিডিওতে দেখা যায়, জ্বলছে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম ‘গাও দু থার আ’। ওই গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। এরপর দেখা যায়, বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান জনাথন হেড ওই গ্রামের একটি ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন যেটিতে তখনো আগুন জ্বলছে।
জনাথন হেড বলেন, ‘আপনারা এসব ঘরে যে আগুন দেখছেন তা দুর্ঘটনাবশত এই মাত্র লাগেনি। বরং তা লাগানো হয়েছে। একটু আগেই আমরা আসার সময়ে কিছু লোককে দেখেছিলাম যারা দা বহন করছেন এবং তাঁরা কথা বলতে রাজি ছিলেন না। একজন অবশ্য পরে স্বীকার করলেন, তাঁরা পুলিশের সাহায্যে এই ঘরগুলোতে আগুন জ্বালিয়েছেন।’
ভিডিওটিতে পুরো দৃশ্যটি দেখিয়ে জনাথন হেডের বর্ণনায় আরো জানানো হয়, ওই তরুণরা সবাই ছিল রাখাইন আর গ্রামটি মুসলিম অধ্যুষিত। অথচ সরকার এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা সবাই দাবি করছেন মুসলমান রোহিঙ্গা জঙ্গিরাই নাকি গ্রামগুলোতে আগুন দিয়েছে। কিন্তু আমরা যা চোখের সামনেই দেখলাম তা পুরোপুরি উল্টো একটি ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের।
এরপর জনাথন হেড মন্তব্য করেন, ‘এখন আমরা যা দেখলাম তা কেবলমাত্র জাতিগত নিধন। রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে বের করে দেওয়ার চিত্র।’
ওই ভিডিওতে আরো মন্তব্য করা হয়, ওই গ্রামগুলোতে যে কয়েকদিন আগেই মুসলমানরা বাস করতেন তার কোনো চিহ্নই নেই। স্থানীয় রাখাইন ও প্রশাসন মিলে মুসলমানদের বাসভূমির শেষ প্রমাণটুকুও মুছে ফেলছে। কোথাও আগুনে পুড়িয়ে, কোথাও লুটতরাজের মাধ্যমে। শক্তিশালী দাহ্য পদার্থ ছিটিয়ে আগুন লাগানোর ৩০ মিনিটের মধ্যে বাড়িঘরগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।