‘বাবাকে খুব মনে পড়ে’

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাষ্ট্রীয় খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হয়ে বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রায় চার লাখ (জাতিসংঘের দেওয়া সর্বশেষ হিসাব) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ বিভিন্ন দেশেই তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
গত ২৪ আগস্ট সহিংসতা শুরু হওয়ার পর পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা থাকা, খাওয়া, পোশাক, অপুষ্টিসহ অসংখ্য সমস্যার মধ্যে করছে মানবেতর জীবনযাপন। তাঁদেরই একজন ১০ বছর বয়সী নূর কাজল। কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া এই শিশু চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে দেখাসহ দুর্বিষহ শরণার্থী জীবনের বর্ণনা দিয়েছে আলজাজিরার প্রতিবেদককে। সেই প্রতিবেদন বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
মিয়ানমারে আমাদের গ্রামে আমরা খুব ভালো ছিলাম। আমি সেখানকার মাদ্রাসায় পড়তাম। পবিত্র কোরআন পড়তে আমার ভালো লাগত, আমি পুরোটাই মুখস্ত বলতে পারতাম। আমাদের পরিবারে সাতজন সদস্য ছিল। আমাদের ঘরটা বেশি বড় ছিল না, কিন্তু সেখানে থাকতেই আমার ভালো লাগত।
কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্বিচার গুলির মুখে আমাদের সেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। সেনারা যখন আমাদের ঘরে জানালা দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে, তখন আমি আর বাবা ঘরের ভিতরে। তাদের ছুড়া বুলেট এসে বাবার মাথায় লাগে। বাবা কাতড়াতে কাতড়াতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বাবার মাথা দিয়ে ঢল ঢল করে রক্ত বেরিয়ে আসছিল।
তখন ভয়ে আমার চোখ-মুখ শুকিয়ে যায়। আমি কাঁদছিলাম আর কাঁদছিলাম। কিন্তু সেনাদের কাছ থেকে বাঁচতে বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় রেখেই আমাকে পালাতে হয়। পরে সেনারা ওই ঘর পুড়িয়ে দেয়। যখন ঘরটা জ্বলছিল তখন বাবা ঘরের ভেতরই পড়ে ছিল।
আমরা বনের দিকে দৌঁড়াতে থাকি, গাছগাছলায় ভরা জঙ্গলে আমরা লুকাই। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আমরা টানা তিনদিন হেঁটে বাংলাদেশে আসি। পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি এই তিনদিন। বাবাকে জ্বলন্ত ঘরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেখে আসা মোটেও আমাদের জন্য সহজ ছিল না। বাবার কথা খুব মনে পড়ে।
সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসতে মানুষজন আমাদের সাহায্য করেছে। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নদী পার হয়েছি। শিশু হলেও এই নৌকায় চড়া আমাদের জন্য কোনো আনন্দের ছিল না। সবসময়ই বাবার কথা মনে পড়ত। আমার কাঠুরে বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। সবাই তাঁকে খুব পছন্দ করত। তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন।
বাংলাদেশে আমি ভালো নেই। বাবাকে বারবার মনে পড়ে। এখানকার পরিবেশও ভালো না, নোংরা। পায়খানা, গোসল করার ব্যবস্থা নেই।
আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। কিংবা এমন কোনো দেশ চাই যেখানে আমরা থাকতে পারব, বাঁচতে পারব। বিশ্ববাসীর কাছে এটাই আমার বার্তা।