হাওরের বিনোদন
“মোবাইলে ছবি দেখি আর ‘ইয়াবা’ খাই”

নেত্রকোনার জেলার একটি আকষর্ণীয় অঞ্চল ডিঙ্গাপোতা হাওর। কয়েক হাজার মানুষের বাস এই অঞ্চলে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগটা রক্ষা হয় ছেচড়াখালি বাজারের মাধ্যমে। তাই বলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই তারা। মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগে সবই এখন তাদের হাতের মুঠোয়।
ডিঙ্গাপোতার দোকানপাট, রাস্তাঘাট বেশ পরিছন্ন। দুটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পাশাপাশি একটি কলেজও যাত্রা শুরু করেছে এ বছর। অবশ্য কোনো হাসপাতাল নেই ডিঙ্গাপোতায়। নিত্য প্রয়োজনীয় সদাইপাতি কেনার জন্য বাজারও রয়েছে এই অঞ্চলে। মোটামুটি সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এখানকার মানুষ। ইদানীং এই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ফোন। বিনোদন বলতে এই এক মোবাইল ফোনে সিনেমা দেখা আর নেশা করা। নেশাদ্রব্যের মধ্যে এখানে ইয়াবা বেশ জনপ্রিয়।
সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ছেচড়াখালি বাজারের মোটরসাইকেল চালক মোহাম্মদ শাহ আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘না ভাই সিনেমা হলে গিয়া ছবি দেখিনা ১০-১২ বছর হবে। মোবাইল ফোনেই তো ছবি দেখা যায়। ২০ টাকা দিয়া কয়েকটা ছবি লোড করাই, সারা রাইত মজা কইরা মোবাইল ফোনে ছবি দেখি আর ‘ইয়াবা’ খাই। আমাদের সিনেমা হলে ছবি দেখতে গেলে ১৪ কিলোমিটার দূরে মোহনগঞ্জ শহরে একটা সিনেমা হল আছে ‘কঙ্কন’, সেখানে যেতে হয়। যেতে আসতে আর ছবি দেখতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা আর খরচ হয় ৩০০ টাকা। এই টাকা দিয়া সিনেমা পামু পাঁচটা সাথে পামু দুইটা বাবা। সারা রাইত খামু আর মজা কইরা মোবাইল ফোনে ছবি দেখমু।’
স্থানীয় চায়ের দোকানদার তারা মিয়া বলেন, ‘১০ বছর আগেও মোহনগঞ্জে সিনেমা হল ছিল তিনটি- মিতালী, দিলশাদ ও কঙ্কন। এখন শুধু কঙ্কনটাই খোলা আছে। তাও কোনো রকমে চলছে। আগে আমাদের এলাকায় কোনো বিয়া হলে সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যেত। এলাকার কোনো মেয়ের স্বামী প্রথমবার আসলে ট্রলার রিজার্ভ করে সিনেমা দেখতে যেত। এখন অটোতে ৪০ মিনিটে যাওয়া যায়, কিন্তু কেউ যায় না। সবাই মোবাইল ফোনে ছবি দেখে আর ইয়াবা খায়। এখানে ১০০ টাকায় ইয়াবা পাওয়া যায়। ছেলেরা বয়স্করা সবাই খায়। আমার একটা ছেলে আছে ১৫ বছর বয়স রিকশা চালায়, সেও ইয়াবা খায় আর মোবাইল ফোন নিয়া সারাদিন পইরা থাহে। ইয়াবা আর এই মোবাইল সিনেমা দেশটা খাইল।’
ঈদে বাড়িতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী বুলবুল চৌধুরী প্রশাসনকে দোষারোপ করে বলেন, ‘এ অঞ্চলে যারা ইয়াবার ব্যবসা করে তারা স্থানীয়দের পরিচিত। এলাকার সবাই এদের চেনে, নাম পরিচয় জানে, কোন জায়গায় বসে খাচ্ছে তাও জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। আর বলবে কি, সবাই তো খায়, বাবা ছেলে এক সাথে বসে নেশা করে, ভাইবোন এক সাথে বসে ইয়াবা খায়। এখান দিয়ে যেহেতু হাওর এলাকার বড় একটা অংশে ইয়াবা ঢোকে, সেজন্য এখানে দাম কম। তাই আশপাশের প্রত্যেকটা গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে এই জিনিস। পুলিশকে কেউ অভিযোগ করে না ভয়ে। দেখা যাবে ১৪ কিলোমিটার দূর থেকে পুলিশ আসার আগেই পাচারকারীরা আমাকে মেরে ফেলেছে।’
এবিষয়ে জানতে চাইলে মোহনগঞ্জ থানার ওসি মো. মেজবাউদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা জানি, এই থানায় প্রচুর ইয়াবা আসে যায়। আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করছি এটা যেন বন্ধ করা যায়। আসলে আমাদের যে পরিমাণ জনবল, থানার সব জায়গাতে এক সঙ্গে যেতে পারব না। এলাকার সাধারণ মানুষ যদি সঠিক তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য না করে তাহলে বিষয়টা সহজ হবে না আমাদের জন্য। এরপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
থানায় অনেকে ভয়েই অভিযোগ করতে চায় না। এ প্রসঙ্গে এলাকাবাসীর উদ্দেশে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা মাদক নিচ্ছে সবাই আপনাদেরই ছেলেমেয়ে, ভাইবোন। আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। যারা আমাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে চান, সরাসরি আমাকে ফোন করে জানান। আমরা সাথে সাথে এর অ্যাকশন নেব। আপনারা যে আমাকে ফোন করেছেন এটা কিন্তু রেকর্ড থাকছে মোবাইল কোম্পানির কাছে। ফোন করার পর কোনো অ্যাকশন না নিলে বা ফোন করাতে আপনার কোনো সমস্যা হলে গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দিন। তবে ফোন করলে সঠিক পরিচয় দিতে হবে। আমরা যেন নিশ্চিত হতে পারি খবরটা সঠিক। এর আগে একটা ফোন পেয়ে চার ঘণ্টা জার্নি করে গিয়ে দেখি, কিছুই না, পারিবারিক সমস্য। আর যদি আমাদের সবসময় সহযোগিতা করতে চান, আপনার নাম পরিচয় বলেন আমি আপনার নম্বর সেভ করে নিচ্ছি। তাহলে আর মনে হবে না খবরটা ভুয়া। আমরাও চাই মাদকমুক্ত সুন্দর সমাজ।’