ঈদের ছুটিতে
পাটন দরবার স্কোয়ার

ভূস্বর্গের এক অনন্য দেশ নেপাল। যাকে হিমালয় কন্যা বলা হয়। রাজকীয় বৈভব,পাহাড়, আর প্রকৃতির হাতছানিতে নেপালের কোনো জুড়ি নেই। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ভারত আর উত্তরে চীন দেশের ভূখণ্ডে ঘেরা নেপালের পাহাড়ি পথ, চঞ্চলা নদনদী, নিবিড় অরণ্য, পাহাড়ি ঝরনা সবই আপনাকে মোহিত করবে।
উঁচু-নিচু এই পাহাড়ই দেশটির মূল স্তম্ভ ও চালিকাশক্তি। যার বেশিরভাগই পাহাড় আর অরণ্য। আর এই পাহাড় ও অরণ্যকে ঘিরেই তাদের বসতি, প্রাকৃতিক লেক, আঁকাবাঁকা সড়ক ও জনপদ গড়ে উঠেছে। এ যেন পাহাড়ের ভূখণ্ডে এক অবিনশ্বর পৃথিবী।
বিমানের জানালা দিয়ে হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্য নয়ন ভরে দেখছি। চেষ্টা করছি মোবাইল এর ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে। ।আগে নানান ভাবে হিমালয় দেখেছি। প্রত্যেকটা পাহাড় চূড়ার দৃশ্যই হৃদয়ে লেগে থাকার মতো। পাখির চোখে হিমালয়ের দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত। এত সুন্দর হিমালয়ের রূপ, চোখের পাতা পড়ছিলো না। নভেম্বরের শুরুর দিকে বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করে।
তাই এ সময়টা কোথায় সাদা বরফে ঢাকা, কোথায় আবার বরফের চাদরে ঢেকে দেওয়ার প্রস্তুতি দেখতে পেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা দুইটা , উড়োজাহাজে চেপে আমরা এসে পৌঁছালাম হিমালয়ার কন্যার দেশে নেপালে-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভ এর অনুষ্ঠানে।

বিমান বন্দরে আমাদের বরণ করে নিলেন নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভ অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক অভিনব দাদা। বাংলাদেশ থেকে আরো অনেকেই এসেছেন এই আয়োজনের সাথে যুক্ত হতে। অভিনব দাদা বললেন আমরা চাইলে এখন কাছাকাছি ভ্রমণ গন্তব্যে ঘুরে হোটেলে উঠতে পাড়ি নতুবা হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে বের হতে পাড়ি। সবাই একবাক্যে বললো আগে ঘুরে নেই আর হোটেলে ঢুকলে পরে বের হতে দেরি হবে। আমরা চার চাকার বাহনে উঠে পড়লাম।
প্রকৃতির উষ্ণ ছোঁয়া বেশ ভালোই লাগছিল। আগের থেকে সবাই বলছিল নেপালে বুঝি বেশ ভালোই ঠাণ্ডা পরে। সেই তথ্য অনুযায়ী ঠাণ্ডা কে মোকাবেলা করার জন্য আমার ভ্রমণ সঙ্গী সানন্দা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। কিন্তু যেমন মনে হয়েছিল ঠাণ্ডা পরে ঠিক এতটা ঠাণ্ডা পরে নাই। পথিমধ্যে আমরা পেট পূজা সেরে নিলাম। আমাদের বাহন একটি গলির সামনে নামিয়ে দিলো সেখানে দেখা পেলাম নেপাল-বাংলাদেশ ইয়ুথ কনক্লেভ এর আরেক সদস্য সুমিত দাদার সাথে। তিনি বললেন সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে আমরা যাবো নেপালের ঐতিহাসিক স্থান পাটন দরবার স্কোয়ারে। আমরা পদব্রজে সবাই এগিয়ে যেতে লাগলাম।
সূর্যদেব পাটে যাওয়ার পথে। পর্যটকদের আনাগোনায় গলিগুলো বেশ জমজমাট। কাঠমান্ডু মন্দিরের শহর বললে ভুল হবে না। পুরো শহর জুড়ে ছোট বড় অনেক মন্দির।

কাঠমান্ডু এমন একটি শহর, যেখানে প্রতি ইঞ্চিতে মিশে রয়েছে ইতিহাস। নেপাল অনেকটা নিঃশব্দ শহর। একই সঙ্গে নিরাপদ। হর্ন না দিয়ে শত শত মোটরবাইক চলছে রাস্তা পারাপারের সময় পথচারীকে গুরুত্ব দিয়ে থেমে যায়। বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করে। যাত্রা পথে দেখতে পেলাম একজন পানিপুরি বিক্রি করছেন। আমার সহযাত্রী সানন্দা লোভ সামলাতে না পেরে নিয়ে নিলেন পানিপুরি। আমি ও স্বাদ আস্বাদন করলাম । সুমিত দা বললেন পাটন দরবার স্কোয়ার যা ললিতপুর নামে খ্যাত। অসাধারণ স্থাপত্য কর্ম এখানে স্থান পেয়েছে। এই স্থান টি হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলিত নিদর্শন। আমরা এগিয়ে চলছি কিন্তু চোখের পলক ফেলতে পারছিনা। অসাধারণ কারুকাজ সম্বলিত সব ভবন। এদিকে সন্ধ্যার আরতি চলছে বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে, কেউ আছেন প্রার্থনায় মগ্ন। আমাদের সব সঙ্গী ছবি তোলায় মগ্ন। আমি ও স্মৃতিটুকু মোবাইলে ধারণ করে রাখার চেষ্টা করছি। কবুতর স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি আর সানন্দা ঢুঁকে পড়লাম একটি মন্দিরের ভেতর ।পাথরে ওপর খোঁদাই করা বিভিন্ন শৈল্পিক কর্ম। নগ্ন পায়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। চারপাশের আগরবাতির গন্ধ আমাদের মোহিত করলো। কিছু সময় সেখানে সময় অতিবাহিত করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। পাটান দরবার স্কয়ার কে বলা চলে পর্যটক দের সমাদৃত। চলতি পথে সুমিত দা বলছিলেন পাটন তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর জন্য বেশ জনপ্রিয়। এখানকার রঙিন বাড়িঘর এবং অসাধারণ স্থাপত্য ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে।

এই প্রাচীন মন্দির গুলোর শিল্পকর্ম যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত হয়ে আসছে। পাটন একটি ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ শহর। যার উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। কাঠমান্ডু এবং ভক্তপুরের পরে পাটন নেপালের তিনটি রাজকীয় শহরগুলোর মধ্যে একটি। চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, পাটন মল্ল রাজ্যের রাজধানী হিসাবে পরিচিত ছিল। এটি মল্ল শাসকদের অধীনে সমৃদ্ধ হয়েছিল।
মল্লরা শিল্প ও স্থাপত্যের প্রতি তাদের ভালবাসার জন্য পরিচিত ছিল। সেই ভালবাসা আজও এখানকার প্রাসাদ এবং মন্দিরগুলোতে দেখা যায়।

পাটন বিশ্বের কিছু দর্শনীয় স্থাপত্য বিস্ময়ের আবাসস্থল। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান পেয়েছে এই পাটান দরবার স্কয়ার। খোদাই করা কাঠের একটি প্রাসাদ। এখানে রয়েছে প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মন্দির। যা দেখতে লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন। পাটনের কৃষ্ণ মন্দির আরও একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি । শত বছর পূর্বের কারিগরদের কাজ দেখে আমরা সবাই অবাক। পাথরে খোদাই করে এই মন্দিরের সোনালি রঙের চূড়া শহরের অন্যতম বিশিষ্ট স্থাপত্য বিস্ময়।

পাটন মিউজিয়াম এই শহরের আরও একটি রত্ন। স্থানটি ধর্মীয় নিদর্শন, ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্মের সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়াও, স্বর্ণ মন্দির, রুদ্র বর্ণ মহাবিহার এবং ভীমসেন মন্দির শহরের অন্যান্য বিশিষ্ট স্থাপত্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে কয়েকটি। আপনি যদি নেপালের শিল্প ও কারুশিল্পের অভিজ্ঞতা নিতে আগ্রহী হন তবে অবশ্যই পাটন এখানে আসতেই হবে। যারা নেপালি অভিজ্ঞতা নিতে চান তাদের এই সাংস্কৃতিক জায়গাটি অবশ্যই পরিদর্শন করা উচিত।
যেভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে নেপালে বিমানযোগে যাওয়া যায় এবং কাঠমান্ডুতে যেতে হলে সেখানকার ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের টিকেট কাটতে হবে। খরচ যাওয়া আসার টিকেট নিয়ে ১৮ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকার আনুমানিক। আগে ভাগে টিকেট কাটতে পারলে ১৭ হাজার টাকার মতো লাগতে পারে। বাই রোডে নেপাল যেতে হলে খরচ কমে যাবে অনেকটা। সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে যেখানে পোর্টের নাম দিতে হবে চ্যাংরাবান্ধা বা রানীগঞ্জ। এখানে বা বিমানে কোনটাতেই নেপালের ইমিগ্রেশনে কোন ভিসা ফি এর দরকার নেই যদি না আপনি একই বছরে দুবার ভ্রমণ করতে চান। চাইলে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভারতের বর্ডার পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে নেপালের কাঁকড়ভিটা পর্যন্ত যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন
থাকতে হলে থামেলের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর দ্বিতীয়টি নেই কারণ পুরো থামেলের গলি ঘুপচিতে অসংখ্য হোটেল/ ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল রয়েছে। ১০০০ থেকে ১৮০০ রুপির মধ্যে ভাল ডাবল রুমের বাজেট হোটেল এখানে পাওয়া সম্ভব। ৬০০ রুপিতে সিঙ্গেল রুমের হোটেল ও এখানে আছে। বাজেট আরেকটু বেশি যেমন ৩০০০ রুপি বা তার বেশি হলে ডিলাক্স রুমের খাবার সহ অনেক ভাল হোটেল পাওয়া যায়। তবে থামেল এর হোটেল এবং তাদের দরদাম ও চেহারা এত বেশি বৈচিত্র্যময় যে আগে থেকে বুকিং না দিয়ে বরং পায়ে হেঁটে ঘুরে কয়েকটি হোটেল ঘুরে যাচাই বাছাই করলে সস্তায় ভাল হোটেল পাওয়া সম্ভব।

যা খাবেন
নেপালের লোকাল খাবার হিসাবে তারা ভাতের থালি কেই প্রাধান্য দেয়। তাই কাঠমান্ডুর যেখানেই যাওয়া হোক না কেন ভাত না খেয়ে থাকা অসম্ভব। ভাতের সাথে মাছ, মুরগী, সালাদ, রায়তা, শাক ও পাঁপড় থালিতে থাকে। নেপাল শীতপ্রধান দেশ বলে সেখানে মোমোর প্রচলন আছে। থামেল ও কাঠমান্ডুর অন্যান্য জায়গায় অসংখ্য মোমোর দোকান আছে। এছাড়া আছে নানা স্বাদের নানা রঙ এর চা ও কফি। ফুলের পাপড়ি থেকেও চা তৈরি করে তারা বিক্রি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এছাড়াও আধুনিক খাবার দাবার সবই এখন কাঠমান্ডুতে পাওয়া যায়।

কাঠমান্ডু ভ্রমণ টিপস
বিমানে যাত্রার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে কাঠমান্ডু যাবার সময় বোর্ডিং অফিসারকে বলে যদি বিমানের বা সারির সিট নেওয়া যায় তাহলে কাঠমান্ডুর এয়ারপোর্টে নাম্বার আগেই হিমালয়ের আইসপিক বিমান থেকে দেখতে পারবেন। তেমনি ভাবে সেখান থেকে আসবার পথে চাইলে আপনি ডান দিকের সিট রিজার্ভ করতে পারেন। নেপালিরা ভীষণভাবে অতিথিপরায়ণ ও সাহায্যকারী। নেপালে গিয়ে খাবার দাবার বাম ন্দির ঘুরবার সময় ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে যথাসম্ভব সম্মান দেখান। টাকা এয়ারপোর্ট থেকে না ভাঙিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে মানি একচেঞ্জ থেকে ভাঙ্গালে রেট বেশি পাওয়া যায়। তবে মোবাইল সিমটি এয়ারপোর্ট থেকে কেনাই ভাল যদি কেউ কিনতে চান। যেহেতু নেপাল ঠাণ্ডার দেশ তাই হোটেল নেবার আগে গরম পানির ব্যবস্থা কেমন তা ভালো ভাবে জেনে হোটেল নেয়া ভাল। অন এরাইভাল ভিসার জন্যে পাসপোর্ট, পাসপোর্টের ফটোকপি, রঙ্গিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি, রিটার্ন টিকেট ও হোটেল বুকিং তথ্য (অনেক সময় লাগতে পারে), ডলার এনডোরসমেন্ট, চাকুরীজীবি হলে NOC এবং স্টুডেন্ট হলে আইডি লাগে।