শীতে নাক-কান-গলার রোগ প্রতিরোধে কী করবেন?

শীতে কিছু রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এর মধ্যে নাক-কান-গলার রোগও বাড়তে পারে। আজ ২৭ নভেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২১৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সজল আশফাক।
প্রশ্ন : কিছু কিছু রোগের বেলায় আমরা দেখি, শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রকোপ বা মাত্রা বেড়ে যায়। তার মধ্যে নাক-কান-গলার সম্পর্কিত অনেক রোগের সংক্রমণ বাড়ে। আপনি বলবেন কি নাক কান গলার কোন রোগগুলো শীতের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এ সময় বেশি দেখা দেয়?
উত্তর : শীতের সময় যেহেতু পরিবেশটা একটু ভিন্ন। ঠান্ডা পরিবেশ, ধুলোবালু বেড়ে যায়, হঠাৎ করে শরীর তখন খাপ খাওয়াতে গিয়ে একটু সমস্যা হয়। তখন দেখা যায়, আসলে প্রথমত মানুষের যেই জিনিসগুলো এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে, এর মধ্যে নাক গলা। এর মধ্যে কান হয়তো একটু পরে আক্রান্ত হয়। যেমন হাঁচি বেড়ে যায়। যাকে আমরা বলি ‘অ্যালার্জিক রাইনাইটিস’। ঠান্ডার জন্য বা ধুলোবালুর জন্য এই সমস্যা হয়। এটি একটি সমস্যা হয়। তারপর নাক বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি হচ্ছে গলা ব্যথা বেড়ে যায়। এটাও তাই। একই পরিবেশের জন্য গলাটা একটু খুসখুস করতে থাকে। কারো কারো চুলকায়। কারো কারো ব্যথা করে। অনেকের অনেক বেশি ব্যথা করতে পারে গলা। আর যদি কারো আগে থেকেই টনসিলের সমস্যা থাকে। সেগুলো এই সময়ে একটু বেড়ে যেতে পারে। আর নাক গলা যখন আক্রান্ত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই পাশে যে কান থাকে, তখন এর যে পথটি সেটিও একটু রুদ্ধ হয়ে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। তখন দেখা যায় কানেও ব্যথা করছে। সাধারণত যেটাকে বলি কানে তালা দেওয়া, সে বিষয়গুলো দেখা যায়। শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় এই সব সমস্যায়, বড়দের চেয়ে।
প্রশ্ন : শীতের সঙ্গে রোগগুলোর সম্পর্ক কোথায়? শীত এলে রোগগুলো বাড়ে কেন?
উত্তর : শীতের পরিবেশটা তো একটা শুষ্ক পরিবেশ। এটি একটি বিষয়। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা অনেক কম থাকে। আর শীতের যে ঠান্ডা পরিবেশ সেটিই অনেক সময় অ্যালার্জির উদ্রেগ করতে পারে। একই সঙ্গে ধুলোবালু তাতে আরো সহযোগিতা করে। এটি আরেকটি বিষয়। আর বাচ্চারা বেশি আক্রান্ত হয়, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। আর যাদের আগে থেকেই টনসিলের সমস্যা রয়েছে বা অ্যালার্জির রাইনাইটিস বা নাকের হাঁচি-সর্দির সমস্যা রয়েছে, তারা একটু আগে আগেই আক্রান্ত হয়। এবং বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হয়। বিষয়টি মূলত পরিবেশগত। কিছু কিছু ভাইরাস বিচরণ বা বংশবৃদ্ধির জন্য এই সময়টি একটি উপযুক্ত পরিবেশ। সে কারণেও সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : শীতের সঙ্গে গলা ব্যথার সম্পর্ক কী?
উত্তর : আসলে ঠান্ডাতে যেটা হয়, ঠান্ডার এই পরিবেশটি একটি বিষয়। কারণ আপনি জানেন যে, মুখের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে। কিছু খারাপ ব্যাকটেরিয়াও এই সময় ঢুকতে পারে। কারণ এই ঠান্ডা পরিবেশে যেটা হয়,ওই ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধি করার জন্য এবং তার বেঁচে থাকার জন্য খুব উপযোগী একটি পরিবেশ। সেই পরিবেশটি যখন সে পায় তখন দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। এবং টনসিল হচ্ছে সে রকম একটি জায়গা যেখানে ব্যাকটেরিয়াগুলো বাসা বাঁধতে পারে। স্বাভাবিকভাবে তার বাসা বাঁধা এবং বংশ বিস্তারের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে সে গলাকে আক্রান্ত করে, তখন তার প্রভাব পড়ে টনসিলের ওপর। টনসিলটা প্রদাহযুক্ত হয়ে যায় এবং তখন দেখা যায় ব্যথা হচ্ছে। মূলত এ কারণেই ঠান্ডা এড়িয়ে যেতে বলা হয়।
এ জন্য এই সব সমস্যায় আমরা বলি উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গারগেল করবেন। একটু লবণ দিয়ে। লবণ একটি অ্যালকেলাই সলিউশন। এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া যেমন বাঁচতে পারে না, একই সময় যখন উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা হয়, তখনো ওই পানির জন্য ব্যাকটেরিয়া টিকতে পারে না। জীবাণুকে ধ্বংস করে, সংখ্যা কমায়। একই সঙ্গে মিউকাস সিক্রিয়েশনকে তরল করে বের করছে। এর সঙ্গে ও ব্যাকটেরিয়াগুলো বের হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : শীত এলে বড়দের এবং শিশুদের একটি সাধারণ সমস্যা হয়। তবে সেটি অসাধারণ বিরক্তিকর হয়। সেটি হচ্ছে সর্দি। এই যে নাকে-মুখে সর্দি আসা সঙ্গে কিছুটা জ্বরও। এই বিষয়টি বাড়ে কেন?
উত্তর : এটির একটি দল আছে যাকে আমরা বলি ফ্লু। ফ্লু-টা আপনি জানেন ভাইরাসজনিত। আমাদের দেশে হয়তো এটি এতটা বেশি নয়। তবে উন্নত বিশ্বের লোকজন এই ফ্লুর জন্য এতটা অসুস্থ হয় যে এটি ফুসফুস পর্যন্ত আক্রান্ত করে থাকে। এবং কিছু কিছু ভাইরাস আছে যার কারণে মৃত্যুও হয়। মানুষ কাজে যেতে পারে না। স্কুলে যেতে পারে না। এ কারণে উন্নত বিশ্বে আমরা দেখেছি সেখানে ফ্লু শটের একটি বিষয় আছে। প্রত্যেক বছরেই একটি নির্দিষ্ট সময়, সাধারণত আগস্ট, সেপ্টেম্বরের দিকে এই ফ্লু শট নেওয়া হয়। এটা এক বছর মেয়াদে কার্যকর থাকে। এটি নিলে খারাপ ধরনের যে ভাইরাসগুলো আছে, সেগুলো যেন আক্রান্ত না করতে পারে। সে জন্য এই ভ্যাকসিনটা কাজ করে থাকে। তবে আমাদের দেশে ফ্লু শটের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা এক দিক থেকে ভাগ্যবান আমাদের যে পরিবেশ এর কারণে। কারণ এই তাপমাত্রায় ভাইরাসগুলো বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। আমাদের অতটা ক্ষতি করতে পারে না। তারপরও আমরা যখন আক্রান্ত হয়ে যাই এগুলো দুর্বল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দিয়ে হয়। একে আমরা বলি ফ্লু। এ ক্ষেত্রে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। নাক যদি বন্ধ থাকে একটি ড্রপ দিয়ে পরিষ্কার করা বা অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধ খেয়ে একটু দমিয়ে রাখা, যাতে নাকের সর্দি একটু কমে। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় দেখা যায় অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টি হিস্টামিন-জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এ সময় গারগেল করা, গরম খাবার খাওয়া, একটু স্যুপ-এগুলো খেলে ভালো হয়। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়, স্যুপ অনেকটা কার্যকরী এই ক্ষেত্রে। কারণ এতে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
এ ছাড়া অন্য কারণে সমস্যা হতে পারে। তবে সেগুলো খুবই সামান্য। তবে যেহেতু রোগটি ভাইরাসজনিত, তাই এত ওষুধপত্র দেওয়ার পরও খুব বেশি উন্নতি হয় না। কারণ এটি ভাইরাসজনিত। একটি সময় পরে এটি ঠিক হয়ে যায়। তবে একটু কষ্ট হয়।
প্রশ্ন : ভাইরাসে আক্রান্ত যাতে না হই, এ জন্য জীবনযাপনের ধরনের পরিবর্তন কতটুকু জরুরি? এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : লাইফস্টাইল (জীবনযাপনের ধরন) একটি বড় বিষয়। কারণ আপনি দেখবেন কেউ কেউ হয়তো বিষয়টি লক্ষ রাখে না। যেমন : ধরুন কারো বাসায় যদি কার্পেট থাকে বা বাসায় যদি সে কোনো পশু পালে। কারো যদি এই সমস্যা থাকে, তার এগুলো করা ঠিক নয়। অথবা ধুলোবালি যদি বেশি থাকে বাসায়, তাহলে সমস্যা হতে পারে। পারলে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করুন। কার্পেট তুলে ফেলে, যদি জাজিম থাকে, সেটাকে বছরে একবার করে বা দুবার করে ভালোভাবে রোদে দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সোফাগুলোকে পরিষ্কার করা। কারণ আপনি জানেন ধুলোর মধ্যে ছোট ছোট অনেক জীবাণু থাকে। যেগুলো অ্যালার্জির উদ্রেক করে। ঘরের মধ্যেই এর উৎস থেকে যায়। অ্যালার্জেনের এই উৎসগুলোকে বন্ধ করতে হবে। জীবন-যাপনের পরিবেশের মধ্যে এটা থাকে যে আমি কী পরিবেশে থাকছি। আর দ্বিতীয়ত, আমি যখন বাইরে বের হচ্ছি, আমি যখন জানি আমার ধুলোতে সমস্যা হয়, গাড়ির ধোঁয়ায় সমস্যা হয়। যদি সম্ভব হয়, আমি মাস্ক ব্যবহার করব। যদি গাড়িতে চলি, তাহলে এসি ব্যবহার করব যেন ধুলোবালু ভেতরে না ঢোকে। বা সেই পরিবেশে আমি যাব না, যেখানে সমস্যা হয়। অনেকে রয়েছে খুব গরম পরিবেশে গেলে বা কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে গেলে সমস্যা হয়। এমন হলে তিনি সেটা এড়িয়ে যাবেন। আসলে জীবনযাপনের পরিবর্তন খুব জরুরি। এখন আমি জানি ঠান্ডা খেলে গলা ব্যথা হবে, আমি আইসক্রিম খেলাম, তাহলে তো হলো না। বা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলাম তাহলে তো ঠান্ডা লাগবেই। অথবা হঠাৎ করে রাতে আমি একটু বারান্দায় দাঁড়ালাম গরম কাপড় ছাড়াই, তখন সমস্যা হয়ে যেতে পারে। এ রকম সামান্য ঘটনা থেকেই ঠান্ডা-সর্দি লেগে যাচ্ছে। দু-তিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন : একজন শিশুর বেলায় সর্দি কেমন হলে তার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : সর্দি যখন লাগে, সাধারণত যখন হাঁচি দেয়, পানি পড়ে নাক দিয়ে তখন শিশুকে লক্ষ রাখব। পারলে একটু অ্যান্টি হিসটামিন-জাতীয় খুব সাধারণ যেসব ওষুধ রয়েছে সেগুলো খাইয়ে দেব। অথবা নাকে সাধারণ স্যালাইন পাওয়া যায় সেগুলো দিলে নাক পরিষ্কার থাকবে। এটি করার পর দুই থেকে তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে। তারপর যদি দেখা যায় সর্দিটা একটু হলুদাভ রঙের হয়ে যাচ্ছে, পেকে যাচ্ছে বা আরো বেশি আঠালো হচ্ছে এবং সেটি যাচ্ছে না, তখন একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে। একই সঙ্গে শুধু সর্দি, সামান্য সর্দি তবে অনেক বেশি কাশি, বাচ্চা রাতে ঘুমাতে পারে না সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা ঠান্ডা-সর্দির সঙ্গে যদি জ্বর থাকে এবং অবশ্যই লক্ষ রাখা উচিত জ্বরের মাত্রা কতটুকু। যদি ১০০-এর মতো থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল দিয়ে অপেক্ষা করেন, ওষুধ দেন। তবে জ্বর যদি অনেক বেশি হয়, বুকের ভেতরে যদি একটু শব্দ করে, একটু শ্বাসকষ্ট হয়, বুকের ওঠানামা যদি স্বাভাবিক মনে না হয়, বুকের ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে, রাতে ঘুমাতে পারছে না; তখন অবশ্যই একজন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ফুসফুসের চিকিৎসা নেওয়া উচিত। আর সেই ক্ষেত্রে যদি দরকারি চিকিৎসা দেয় সেই ক্ষেত্রে বাচ্চাটা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
আরেকটি হচ্ছে ঠান্ডা সর্দি লাগছে বাচ্চা বলছে অনেক কান ব্যথা করছে, এ ক্ষেত্রেও দ্রুত একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ পরামর্শ না নিলে ঠান্ডা সর্দি মধ্য কর্ণে প্রদাহ তৈরি করে ফেলে এবং অল্প সময়ের মধ্যে এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা যায়, কানের পর্দা ফুটো হয়ে যেতে পারে। তবে একই জিনিস যদি আপনি ঠিক সময়ে চিকিৎসা নেন তাহলে কানের এই রোগটি পুরোপুরি সেরে যাবে।