শিশুদের কিডনি রোগের লক্ষণ কী?

বিভিন্ন কারণে শিশুদের কিডনির রোগ হয়। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আজ ১১ ডিসেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৩১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু ইউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল আজিজ।
প্রশ্ন : শিশুদের বেলায় কিডনি রোগ কেন হয়?
উত্তর : অনেক কারণেই শিশুদের কিডনিতে সমস্যা হয়, যেগুলো সাধারণত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভালো হয়। কিছু কিছু সমস্যা ওষুধের মাধ্যমে ভালো হয়। ওষুধের মাধ্যমে যেগুলো ভালো হয়, এগুলোকে ন্যাফ্রোটিক সিনড্রম বলি, নেফ্রাইটিস বলি, টিউবার কোলোসিস অব দ্য কিডনি বলি। এসব কারণে সাধারণত কিডনিতে সমস্যা হয়। এগুলো ওষুধের মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব। আর কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে, যেগুলো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব। যেমন : কিডনিতে পাথর হতে পারে, কিডনিতে কিছু টিউমার হয়—এ রকম অনেক অসুখ রয়েছে, যেগুলো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব।
প্রশ্ন : শিশুদের বেলায় কিডনি রোগের কারণ কী?
উত্তর : টিউবার কোলোসিস বড়দের হতে পারে বা শিশুদের হতে পারে। নেফ্রোটিক সিনড্রম যেটি, সেটি সাধারণত বাচ্চাদের হয়। ১২ বছর বয়সের পর সাধারণত এগুলো ভালো হয়ে যায়। এগুলোর নির্দিষ্ট কারণ বলা যায় না। তবে জিনগত কারণ রয়েছে , খাবার থেকে কিছু সমস্যা হয়। এর পর দরিদ্র লোকদের এসব সমস্যা বেশি হয়। সার্জিক্যাল যে সমস্যাগুলো হয়, যেমন—হাইড্রোনেফ্রসিস বলি, কোনো কোনো সময় দেখা যায় পাথর হয়ে প্রস্রাব আটকে যাচ্ছে, তাহলেও হাইড্রোনেফ্রসিস হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রস্রাব যে পথ দিয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানে যদি কোনো বাধা থাকে, তখন প্রস্রাব পেছনে চলে আসে, কিডনি ফুলে যায়—এখান থেকে হাইড্রোনেফ্রসিস বলি।
প্রশ্ন : শিশুদের একিউট রেনাল ফেইলিউরজনিত সমস্যা কী এবং কাদের বেশি হয়?
উত্তর : ডায়রিয়া হওয়ার কারণে অথবা যদি বমি হয় অথবা যদি পানি কম খায় অথবা একটা বাচ্চাকে যদি খুব গরম জায়গায় রাখা হলো, তার ঘাম হলো, তাহলে দেখা যায় পানিশূন্যতা হয়। পানিশূন্য যখনই হয় তখন দেখা যায়, কিডনিতে আর কোনো প্রস্রাব হয় না। প্রস্রাব যখন তৈরি না হয়, তখন একে আমরা কিডনি ফেইলিউর বলি বা একিউট রেনাল ফেইলিউর বলি। অনেক সময় যদি রোগ হয়ে বারবার কিডনিতে সংক্রমণ হয়, এ অবস্থায় কিডনি ফেল করে তখন ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর বলি। একজন মানুষের প্রতিদিন পানি খাওয়ার একটি অনুপাত আছে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বলা হয়, দুই থেকে তিন লিটার পানি খেতে হবে। বাচ্চাদের ওজন অনুযায়ী বলি, কারো এক লিটার বা দেড় লিটার বা কিছু কম লাগে। তবে সবাইকেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি প্রতিদিন খেতে হবে। এই পানি যদি কম খায় অথবা কারো যদি বারবার পাতলা পায়খানা হয় বা বারবার বমি হয়, তাহলেও এ সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুদের বেলায় কিডনি রোগের লক্ষণ কী?
উত্তর : জন্মের পর কিছু কিছু বাচ্চার দেখা যায় প্রস্রাব হচ্ছে না। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি প্রস্রাব না হয়, তাহলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে হয়তো ধারণাটা ঠিক নেই অথবা তারা ঠিকমতো অনেক সময় বুঝতে পারে না। বাচ্চা হওয়ার পরই তাদের ধারণা, পায়খানা-প্রস্রাব হবে। পায়খানা হওয়ার বা প্রস্রাব হওয়াটা এক রকম নয়, যেমন : একজন মানুষের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পায়খানা হতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পায়খানা তার বের হয়ে যাবে। একে আমরা মিকোনিয়াম বলি। তিন দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ পায়খানা হয়ে যাবে।
কিডনির ক্ষেত্রে বিষয়টি ওই রকম নয়। প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে একটি বাচ্চা প্রস্রাব না-ও করতে পারে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণত প্রস্রাব করলে সেটা স্বাভাবিক। এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, অপেক্ষা করা উচিত।
তবে একটি বিষয় হলো, একজন মানুষের প্রতিদিন কতটুকু প্রস্রাব হবে? আমরা বলি, একটি বাচ্চা যদি ১০ কেজি হয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাহলে অন্তত তার ৩০০ থেকে ৪০০ এমএল প্রস্রাব বের হতে হবে। যদি প্রতিদিন একজন মানুষের ৫০ এমএলের নিচে ইউরিন আসে, তাহলে আমরা তাকে প্রস্রাব তৈরি হচ্ছে না সে পর্যায়ে চিন্তা করব। সেটা হলো শিশুদের জন্য খুব ঝুঁকির কারণ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : এ ছাড়া পা ফুলে যাওয়া বা মুখ ফুলে যাওয়া এ রকম কোনো লক্ষণ কি দেখা দিতে পারে?
উত্তর : পা ফুলে যাচ্ছে। সেটা হচ্ছে সাধারণত যেগুলো মেডিকেল কারণে হয়, হয়তো প্রোটিনের অভাব হলো, প্রস্রাব তৈরি হওয়ার জন্য শরীরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রোটিন লাগে। যেটা রক্তকে ব্লাড ভেসেলের মধ্যে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে। কোনো কারণে যদি একজন মানুষের প্রোটিনের মাত্রা কমে যায়, তাহলে শরীরের পানি ব্লাড ভেসেল না গিয়ে কোষে ঢুকে যায়। এতে শরীর ফুলে যায়। অনেক সময় হৃৎপিণ্ডের সমস্যার কারণেও এটি হয়। সাধারণত যদি কিডনির সমস্যার জন্য হয়, আমরা দেখি যে মুখটা ফুলে গেছে। হার্টের সমস্যার কারণে হলে দেখা যায় পা ফুলে গেছে। এ রকম বিভিন্ন রকম জিনিস থেকে চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করেন। এর পর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন।
প্রশ্ন : সার্জারি করে কি কিডনি রোগ ভালো করা যায়?
উত্তর : সার্জিক্যাল সে সমস্যাগুলো, সেগুলো অস্ত্রোপচার করলে একদম ভালো হয়, যেমন—হাইড্রোনেফ্রসিস। এতে যে শিশুর খুব ব্যথা করা বা কষ্ট হয়, সেটি নয়। বাচ্চাকে হয়তো গোসল করাচ্ছে মা। হয়তো দেখল, বাচ্চার পেটের মধ্যে এক রকম চাকা হয়েছে। তখনই তারা বুঝতে পারে, শিশুটির পেটের মধ্যে একটি টিউমার হয়েছে। এটা খুব বেশি ব্যথাও করে না। সামান্য ব্যথা হতে পারে। এর জন্য একটি আলট্রাসনোগ্রাম করে, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা হয়। এর পর একটি অস্ত্রোপচার করি। এই অস্ত্রোপচার করলে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
এর পর প্রস্রাবের রাস্তায় একটি পর্দা আছে, পোস্টোরিক্যাল ভাল্ভ বলি। একটি মেশিন রয়েছে সিস্টোস্কোপ এটি দিয়ে ভাল্ভ কেটে দেওয়া হলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। অনেক সময় টিউমার যদি থাকে, এ ক্ষেত্রে পাথর ফেলে দিতে হয়। আর যদি সম্পূর্ণ কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিডনিটাও ফেলে দিতে হয়।
প্রশ্ন : শিশুদের কিডনির বেলায় কি পেট কেটে অস্ত্রোপচার করতেই হয়, নাকি উন্নত কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে?
উত্তর : না, সব ক্ষেত্রেই যে পেট কেটে অস্ত্রোপচার করতে হবে, সেটি নয়। ল্যাপারেস্কোপির মাধ্যমে অনেকগুলোই করা যায়। সম্প্রতি হাইড্রোনেফ্রসিস লাম্বেক্টোমি করা হয়। ছোট ১ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা ৩ সেন্টিমিটার ছিদ্র করে এই অস্ত্রোপচারগুলো করা হয়। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এটি খুব নিরাপদ, বাচ্চা সুস্থ হয়ে যায়।
প্রশ্ন : যদি কোনো বাচ্চার ৪৮ ঘণ্টার বেশি প্রস্রাব বন্ধ নেই, কিন্তু তার টিউমার বা এ জাতীয় সমস্যা আছে, তারা যদি এটা মনে করেন চিকিৎসা পরে করব বা সার্জারি না করাই, তাহলে কি এটা জটিলতার দিকে যেতে পারে কি না বা কী হতে পারে?
উত্তর : বাচ্চাদের সার্জারির সময় খুব জরুরি। ধরেন যদি হাইড্রোনেফ্রসিস হয়, ওর কিডনির টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিডনির কার্যক্রম খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে জন্য যত দেরি করা হবে, ততই বাচ্চার কিডনির জন্য বড় রকম সমস্যা হয়ে যাবে। আর সময়মতো যদি অস্ত্রোপচার করা হয়, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। এ জন্য দেরি না করে সময়মতো অস্ত্রোপচার করা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।